মণিরাজ ঘোষ, মেদিনীপুর, ২৫ মার্চ:”আমার বাবা (প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য) এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। কিছুটা কাকতালীয় মনে হলেও সত্য যে, উনি যে বছর এই কলেজ থেকে পাস করেন, সেই বছর ছিল মেদিনীপুর কলেজের একশো বছর পূর্তি (১৯৭৩)! আর, আজ বাবা ১৫০ বছর উদযাপনের এই মঞ্চে বসে আছেন। একজন সন্তান হিসেবে আমি তা মঞ্চে দাঁড়িয়েই দেখছি। বিশ্বাস করুন এরকম মুহূর্ত বারবার তৈরি হয়না! আমার, মেদিনীপুর কলেজের সঙ্গে স্মৃতি হল, আমার উচ্চ মাধ্যমিকের (২০০৪) রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলেছিলাম ড্রামা (নাটক বিষয়ের)’র ফর্ম। ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। কিন্তু, আমার বাবা, জেঠামশাই (বিদ্যুৎ ভট্টাচার্য) সহ পরিবারের সকলে বললেন, বিকল্প আর একটা কোথাও ফর্ম তুলতে! ঠিক সেকারণেই, ইচ্ছে না থাকলেও মেদিনীপুর কলেজ থেকে তুলেছিলাম ফিলজফি (বা, ফিলোসফি/Philosophy) অনার্সের ফর্ম।” এরপরই, অনির্বাণ যোগ করেন, “আজ (২৫ মার্চ) যখন প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে একজন আমায় জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা সত্যিই কি আপনি ফিলজফি অনার্স পড়তে চেয়েছিলেন? আমি বললাম, একদম না, কখনোই না!” হ্যাঁ, বর্তমান সময়ে শুধু টলিউড ইন্ডাস্ট্রিই নয়, এই দেশের অন্যতম প্রতিভাবান অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য একজন ‘সফল অভিনেতা’ই হতে চেয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যেই মেদিনীপুর শহর থেকে ২০০৪ সালে কলকাতায় (রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়) পাড়ি দিয়েছিলেন অনির্বাণ। তাঁর স্বপ্নপূরণ হয়েছে! মেদিনীপুর কলেজ (স্বশাসিত) এর সার্ধশতবর্ষের মঞ্চে দাঁড়িয়ে, অডিটোরিয়াম (বিবেকানন্দ হল) ভর্তি ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, অতিথি, সাংবাদিকদের সামনে স্বীকারও করলেন সেকথা। আর, সেই সঙ্গে নিজের শহরে (মেদিনীপুরে) এসে, ডুব দিলেন স্মৃতির সেই স্বর্ণালী সময়ে! অনির্বাণ বললেন, “মেদিনীপুর আমার নিজের শহর, প্রাণের শহর, আমার মাটির শহর, আমার বন্ধুত্বের শহর, ঘুরে বেড়ানোর শহর, অমনোযোগী লেখাপড়ার শহর!” তাই, তাঁর মতে, “সব ভালোবাসা একদিকে, মেদিনীপুরের ভালোবাসা একদিকে!”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সার্ধশতবর্ষ (১৫০ তম বর্ষ) উদযাপন অনুষ্ঠান উপলক্ষে, বছরভর নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে চলেছে সারা দেশের অন্যতম বিখ্যাত এবং ঐতিহ্যমন্ডিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেদিনীপুর কলেজ (স্বশাসিত)। অতিমারীর কারণে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান জানুয়ারি মাস থেকে পিছিয়ে আয়োজিত হচ্ছে, গত ২০ মার্চ (২০২২) থেকে। তা চলবে আগামীকাল অর্থাৎ ২৬ মার্চ অবধি। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষেই এদিনের ‘অতিথি’ হিসেবে শুক্রবার সকাল ১১ টা নাগাদ কলেজে পৌঁছেছিলেন এই সময়ের জনপ্রিয় নায়ক তথা ‘মেদিনীপুরের গর্ব’ অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য। তুমুল উন্মাদনার মধ্য দিয়ে কলেজে প্রবেশ করন তিনি। প্রথমেই অধ্যক্ষের ঘরে গিয়ে কিছু সময় কাটান। তারপর, বেলা ১২ টা নাগাদ কলেজের বিবেকানন্দ হলে তাঁকে বরণ করে নেন কলেজের অধ্যক্ষ ড. গোপাল চন্দ্র বেরা। অনির্বাণের সঙ্গে একমঞ্চেই অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁর বাবা প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, জেঠু বিদ্যুৎ ভট্টাচার্য প্রমুখ। মঞ্চের নীচে ছিলেন দিদি, ভাগ্নি সহ অনেকেই। অনির্বাণ তাঁর নিজের শহরের ঐতিহাসিক এই কলেজে পা রেখেই আপ্লুত হয়ে পড়েন! নিজের মুখেই স্বীকার করেন সেকথা। আর, সেই সঙ্গেই তিনি ফিরে যান মেদিনীপুর শহরে কাটানো তাঁর ছেলেবেলার দিনগুলোতে। কলেজিয়েট স্কুলের সামনে থাকা ‘আবার খাবো’র রকমারি খাবার থেকে সাইকেল নিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর কথা তিনি স্মরণ করেন। তবে, সেই ছেলেবেলা বা ছাত্রবেলা’র স্বাধীনতা যে এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে আর নেই, তা আক্ষেপের সুরে বলেন অনির্বাণ। অনির্বাণ বলেন, “একটা আটা বা ময়দা’র গোলাকে যদি মাটিতে গড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে তা কিছুক্ষণের মধ্যেই ধুলোয় মাখামাখি হয়ে যায়। আমরা ৯০ এর দশকে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা, আমাদের ছেলেবেলাটা এরকমই গড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম। কোনো উদ্দেশ্য ছিলনা! এখন আর সেটা সম্ভব নয়।”
অনির্বাণ সফল অভিনেতা হয়েছেন। তবে, তিনি স্বীকার করেন, সফল অভিনেতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও ‘জীবন দর্শন’ এর ভূমিকা অনস্বীকার্য! বরং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। অনির্বাণ এদিন, তাঁর গাওয়া প্রিয় দু’টি গানও শোনান। তিনি খালি গলাতেই গাইলেন, “সময়ের ঘষা লেগে, শিলালিপি যায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে/ আমি একা বসে থাকি প্রেমিকের অপেক্ষা হয়ে… কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালোবাসা ছাড়া/ আমিও তাদেরই দলে বারবার মরে যায় যারা।” অনির্বাণ কলেজ পড়ুয়াদের কাছে আবেদনের সুরে বলেন, “জীবনে ডিপ্রেশন, কনফিউশন আসবে। আসতেই হবে, কারণ তোমরা লেখাপড়া করছো। সেগুলিকে হালকা ভাবে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কনফিউশন থেকে ভালো-খারাপের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সেটা খুব প্রয়োজন। তোমরাই পার কনফিউশন জয় করে, এই সমাজটা বদলাতে।” অনির্বাণ তাঁর অত্যন্ত প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ নাটকের একটি গানও এদিন করেন, আবেগের সাগরে ভেসে গিয়ে, “আমার তরী ছিল চেনার কূলে/ বাঁধন যে তার গেল খুলে/ তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেল/ কোন অচেনার ধারে!” মেদিনীপুর কলেজের একঝাঁক নবযৌবনের মাঝে এক অন্য মেজাজে এদিন ধরা দেন এই সময়ের অন্যতম সুপ্রতিষ্ঠিত এই নায়ক। বারবার তাঁর ভালোলাগা, ছেলেবেলা, সাফল্য, গর্বের মুহূর্তের কথা তুলে ধরেন। বলেন, এই অনন্য স্মৃতি ‘মনের মনিকোঠায়’ বন্দী করে রাখার কথাও! তবে, তাঁর একটাই আক্ষেপ, “সফল অভিনেতা হয়েছি। তবে, এই সমাজটার কোনোকিছুই বদলাতে পারলাম না! একদিন স্বপ্ন দেখতাম, জীবনে এমন কিছু হব, যাতে অনেক কিছু বদলে দিতে পারি! কিন্তু, একজন অভিনেতা হিসেবে থিয়েটার, সিনেমা হল বা অডিটোরিয়ামের মধ্যে তাৎক্ষণিক সময়ের জন্য কিছু মানুষের মন হয়তো ওই বদলে দিতে পারি। কিন্তু, তা শুধুমাত্র ওই সময়টুকুর জন্যই। হল থেকে বেরোলেই আবার সেই একই! কিচ্ছু বদলায় না, কেউ বললান না। এই আক্ষেপটাই থেকে গেল।” আর, সমাজ বদলের এই দায়িত্বটাই মেদিনীপুরের ‘নতুন প্রজন্ম’ এর হাতে তুলে দিয়ে, অনেক ভালোবাসা ছড়িয়ে আর ভালোবাসা গ্রহণ করে, ফের টলিউডের লাইট, ক্যামেরা, সাউন্ডের জগতে পাড়ি দিলেন অভিনেতা অনির্বাণ, যাঁর প্রিয় সংলাপ (Dialogue), “I want to be an actor, that’s it!”
Powered by Embed YouTube Video অনির্বাণের প্রাণের কথা:
দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৩ নভেম্বর: শোকসংবাদটা পৌঁছেছিল শুক্রবারই। বুকে পাথর চেপে অপেক্ষা…
দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৩ নভেম্বর: মামিমাকে অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার যুবক।…
দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২১ নভেম্বর: রাজ্যের দাপুটে মন্ত্রী মানসরঞ্জন ভুঁইয়ার 'খাসতালুক' সবংয়ে…
দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৯ নভেম্বর: ওড়িশার বেসরকারি কলেজে বাংলার ছাত্রের রহস্যমৃত্যু! খুনের…
দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১০ নভেম্বর: হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হলো মেদিনীপুর শহর…
দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৯ নভেম্বর: তৃণমূল কংগ্রেসের পঞ্চায়েত সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে এনুমারেশন…