দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৮ এপ্রিল: লেভেল ক্রসিংয়ের ওপারে হাসপাতাল। এই পারে টোটোর উপর বুকের অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন বৃদ্ধ। লাইন ধরে ধীর গতিতে এগিয়ে আসে মালগাড়ি। বৃদ্ধের শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হতে থাকে! দু’হাত দিয়ে প্রাণপণে শ্বশুরমশাইয়ের বুকে পাম্প করে যান বৌমা। স্কুটার থেকে নেমে ছুটে আসেন বিএমওএইচ (BMOH)। তবে, শেষ রক্ষা আর হলো কই! ‘অভিশপ্ত’ লেভেল ক্রসিংয়েই ছেলের কাঁধে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বেলদার মনীন্দ্রনাথ ষড়ঙ্গী। রবিবার সকালের এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘিরে সমগ্র বেলদা জুড়েই শোক আর ক্ষোভের আবহ! বেলদার যুবক চন্দন নন্দ থেকে শিক্ষক সোমনাথ মাইতি, সকলের একটাই প্রশ্ন, আর কত কষ্ট-যন্ত্রণার বিনিময়ে তৈরি হবে বেলদার বহু প্রতীক্ষিত উড়ালপুল?

পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদার নবোদয়পল্লীর বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত ডাককর্মী মনীন্দ্রনাথ ষড়ঙ্গী সোমবার সকালে বাথরুমে গিয়ে বুকে ব্যাথা অনুভব করেন। তারপর সেখানেই বুকে হাত দিয়ে বসে পড়েন। দ্রুত একটি টোটো ডেকে, তাতে বৃদ্ধকে চাপিয়ে ছেলে-বৌমা বেলদা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু, বাধ সাধল বেলদার কেশিয়াড়িমোড়ের ‘অভিশপ্ত’ সেই লেভেল ক্রসিং! টোটো লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে সবে পৌঁছেছে, চোখের সামনে রেল গেট পড়ে যেতে দেখেন মনীন্দ্র বাবুর ছেলে-বৌমা। এদিকে বুকে অসহ্য যন্ত্রনায় তখন কাতরাতে থাকেন বৃদ্ধ মনীন্দ্রনাথ ষড়ঙ্গী। প্রাণপণে তাঁর বুকে পাম্প করে যান বৌমা। বাবাকে জড়িয়ে ধরে, মাথায় ক্রমাগত হাত বোলাতে থাকেন ছেলে মৃত্যুঞ্জয় ষড়ঙ্গী। তাঁদের আর্তনাদ শুনে স্কুটি থেকে নেমে ছুটে আসেন বেলদার BMOH ডাঃ আশিস মন্ডল। লেভেল ক্রসিংয়ে আটকে পড়েছিলেন তিনিও। অভিজ্ঞ ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক তাঁর মতো করে চেষ্টা চালান, কিন্তু কাছে তো কোনও ওষুধপত্র নেই! তাই, তিনিও অসহায় ভাবে অপেক্ষা করতে থাকেন কখন রেলগেট উঠবে তার জন্য। এদিকে, ধিক ধিক গতিতে এগিয়ে আসা মালগাড়ি বেলদা স্টেশনের সামনে এসে গতিবেগ যেন আরও কমিয়ে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। ততক্ষণে হৃদরোগে আক্রান্ত মণীন্দ্রবাবুর জীবন থেকে চলে গেছে মূল্যবান ১৫ থেকে ২০ মিনিট। রেল গেট ওঠার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাই হাসপাতালে পৌঁছে গেলেও, চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন! বয়স ৭৫ হয়ে গেলেও মনীন্দ্র বাবু যথেষ্ট কর্মক্ষম ও প্রাণচঞ্চল ছিলেন বলে এলাকাবাসীদের দাবি। তাঁর এভাবে মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা! হাহাকার করছেন ছেলে, বৌমা সহ পরিজনেরা। মনীন্দ্র বাবুর বড় ছেলে মৃত্যুঞ্জয় বলেন, “কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই! চোখের সামনে সব শেষ হয়ে গেল!”
মনীন্দ্র বাবুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গেই ছিলেন স্থানীয় যুবক চন্দন কুমার নন্দ। চন্দন বলেন, “এর আগেও একাধিকবার এমন ঘটনা ঘটেছে। কেউ শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে পৌঁছাতে পেরেছেন, আবার কেউ পারেননি! আর কত কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে বেলদাবাসীকে? ৫ বছর ধরে শুনছি উড়ালপুল হবে। কবে হবে?” বেলদার বিধায়ক সূর্যকান্ত অট্ট বলেন, “মর্মান্তিক ঘটনা! শোক প্রকাশ করার ভাষা নেই। আমরা সবরকম ভাবে পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিচ্ছি। আসলে ৫ বছর ধরে বিজেপি-র সাংসদ (দিলীপ ঘোষ) তো কিছুই করতে পারেন নি! আমি বিধায়ক হওয়ার পর বার বার রেলের সঙ্গে কথা বলে শেষপর্যন্ত উড়ালপুলের অনুমোদন সহ জমিজট মিটিয়েছি। চলতি বছরই কাজ শুরু হবে বলে আমরা আশাবাদী।” বিজেপি-র জেলা মুখপাত্র অরূপ দাস বলেন, “এই বিষয়ে একটাও রাজনৈতিক কথা বলবনা। অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা। পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। আর এটা সবাই জানে, দিলীপ দা-র উদ্যোগেই বেলদায় বহু প্রতীক্ষিত উড়ালপুল হতে চলেছে।”