দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৪ ডিসেম্বর: ৩ এপ্রিলের পর ৩ ডিসেম্বর। এ রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ঠিক ৮ মাসের ব্যবধানে সম্পূর্ণ ‘বিপরীত’ এক রায়! ৩ ডিসেম্বর, বুধবার বিকেলে প্রাথমিকের ৩২ হাজার চাকরি বাতিল মামলার রায় দিতে গিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, কিছু নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে। সেজন্য সকলের চাকরি বাতিল করা উচিত বলে মনে করে না হাইকোর্ট। এতে ৩২ হাজার পরিবারের উপর ‘বিরূপ’ প্রভাব পড়তে পারে। অন্যদিকে, গত ৩ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার স্কুল সার্ভিস কমিশনের ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী মামলার চূড়ান্ত রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ প্রায় ৮ হাজার ‘দাগি’ (টেন্টেড) শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের ‘চিহ্নিত’ করা সত্ত্বেও, প্রতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে তোপ দেগে পুরো প্যানেল বাতিল করেছিলেন। অর্থাৎ, যোগ্য-অযোগ্য সকলেরই চাকরি বাতিল করেছিলেন।


স্বাভাবিকভাবেই ৩ ডিসেম্বরের হাইকোর্টের রায়ের পর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন রাজ্যের ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকা। অন্যদিকে, এই রায়কে ‘স্বাগত’ জানিয়েও ক্ষোভে-হতাশায় মুষড়ে পড়েন ৩ এপ্রিলের সুপ্রিম রায়ে চাকরি হারানো ‘যোগ্য’ (আনটেন্টেড) শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা। যোগ্য শিক্ষকদের আন্দোলনের অন্যতম ‘মুখ’ তথা পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের দেউলি কলসবাড় রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠের রসায়নের শিক্ষক কৃষ্ণগোপাল চক্রবর্তী বলেন, ‘প্রাথমিকের বন্ধুদের অভিনন্দন জানাই। আদালত তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের কথা ভেবে সকলের চাকরিই বহাল রেখেছেন। অথচ, আমাদের ক্ষেত্রে অযোগ্য বা দাগিদের চিহ্নিত করা সত্ত্বেও সকলেরই চাকরি বাতিল করা হলো। আমাদের কি পরিবার নেই? আমাদের কি সামাজিক সম্মান নেই? এক যাত্রায় এই পৃথক ফল দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি।’
গণিতে ‘গোল্ড মেডালিস্ট’ তথা নারায়ণগড়ের ভদ্রকালী গান্ধী বিদ্যাপীঠের একাদশ-দ্বাদশের শিক্ষক অভিজিৎ গিরি বলেন, ‘কোনও সন্দেহ নেই দুই ক্ষেত্রেই অনিয়ম, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হয়েছে। তবে, প্রাথমিকের ওএমআর খুঁজেই পাওয়া যায়নি আর আমাদের ওএমআর উদ্ধারের পর অযোগ্য বা দাগিদের চিহ্নিত করা হলো। তা সত্ত্বেও মাত্র ১৮০৬ জন ‘টেন্টেড’ শিক্ষক-শিক্ষিকার জন্য বাকি ১৫৪০৩ জন যোগ্য বা আনটেন্টেড শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি বাতিল করে দেওয়া হলো। বলা হলো সবাইকে একসাথে পরীক্ষায় বসতে হবে। আর প্রাথমিকে এই সবকিছুর উল্টো রায় হলো। ‘অনিয়ম’ মেনে নিয়েও মানবিকভাবে বিচার করা হলো। অথচ, আমাদের অন্যায়ভাবে ‘বলি’ দেওয়া হলো!’ পূর্ব মেদিনীপুরের মোবারকপুর এ.এম.এসসি হাই স্কুলের নিউট্রেশন বিষয়ের একাদশ-দ্বাদশের শিক্ষিকা উমা দাস বলেন, ‘এক যাত্রায় এভাবে যদি পৃথক ফল হয়, আদালতের উপর সাধারণ মানুষ আর ভরসা করবে?’ ঝাড়গ্রামের কাপগাড়ি সেবাভারতী বিদ্যায়তনের একাদশ-দ্বাদশের রসায়নের শিক্ষিকা অঙ্কনা দাস বলেন, ‘ওঁরা (প্রাথমিকে) ২০১৭-‘১৮ সাল থেকে চাকরি করছেন, আমরাও ২০১৮-‘১৯ সাল থেকে যোগ্যতার সাথে চাকরি করে আসছি। আমরা যোগ্য ও ত্রুটিমুক্ত শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির জন্য আমাদের বলি দেওয়া হলো। একবারও আমাদের পরিবার, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করা হলোনা!’ কৃষ্ণগোপাল, অভিজিৎ, অঙ্কনা, উমা সকলেরই একটাই দাবি, ‘অবিলম্বে স্কুল সার্ভিস কমিশনের সকল যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের সসম্মানে স্কুলে ফেরানো হোক।’ আর আদালতের উদ্দেশ্যে তাঁদের প্রশ্ন, “দু’টো রায়ের (সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের) কোথাও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য সিস্টেমের বিরুদ্ধে কড়া নির্দেশ নেই। বরং, যাঁদের মাধ্যমে এই সমস্ত দুর্নীতি বা অনিয়ম ঘটেছে তাঁরা জামিন পেয়ে বহাল তবিয়তে ঘুরছেন। অথচ, দুর্নীতির ফল ভুগতে হচ্ছে SSC-র ‘যোগ্য’ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের। এটাই কি তবে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা?”











