মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৮ অক্টোবর: তিলোত্তমার কার্নিভাল উন্মাদনার ঢেউ এবার আছড়ে পড়লো জেলায় জেলায়। অনুপ্রেরণায় অবশ্যই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী! ইউনেস্কো (UNESCO)’র তরফে বাংলার দুর্গাপূজা-কে ‘হেরিটেজ’ (ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি) তকমা দেওয়ার পরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, এবার জেলাতেও হবে পূজা কার্নিভাল। সেই মতো, আজ (৮ অক্টোবর) কলকাতার রেড রোডে কার্নিভাল অনুষ্ঠিত হওয়ার একদিন আগেই, প্রতিটি জেলায় (বিশেষত, জেলা শহরগুলোতে) শুক্রবার (৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হল- ‘পূজা কার্নিভাল ২০২২’ (Puja Carnival 2022)। পুজোর পর বিসর্জনের শোভাযাত্রা’কে এভাবে সুসজ্জিত ও জাঁকজমকপূর্ণ কার্নিভালের রূপ দেওয়ার ঘটনা, জেলাগুলিতে এবারই প্রথম। আর, ‘প্রথম’ বলেই জেলাগুলিতে উৎসাহ ও উদ্দীপনা একটু বেশিই ছিলো। একইসঙ্গে, ধরা পড়লো নানা ত্রুটি বা অসঙ্গতিও! কয়েক ঘণ্টার জন্য সমস্যায় পড়তে হলো সাধারণ পথচারী তথা গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্মে রাস্তায় বেরোনো পথচারীদেরও। সবমিলিয়ে, ভালোয়-মন্দোয় জেলাবাসী প্রথমবার উপভোগ করলেন পুজোর কার্নিভাল। উৎসাহ ছিলো অংশগ্রহণকারী পুজো কমিটিগুলির মধ্যেও। যদিও, কার্নিভাল ঘিরে চরম অব্যবস্থা এবং লক্ষ লক্ষ টাকা নয় ছয়-কে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি বিরোধীরা! বিশেষত, একদিকে যখন প্রশাসনের গাফিলতিতে জলপাইগুড়ির মাল নদীতে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা, ঠিক তখনই সরকারি উদ্যোগে এই ধরনের ‘আয়োজন’ কতখানি প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।

thebengalpost.net
বাংলার কৃষি – রবীন্দ্রনগর :

শুক্রবার সন্ধ্যা ছ’টা থেকে জেলা শহর মেদিনীপুর ও রেল শহর খড়্গপুরেও অনুষ্ঠিত হল পূজা কার্নিভাল। মেদিনীপুরে ১৭-টি এবং খড়্গপুরে ১১-টি পুজো কমিটি এবার কার্নিভালে অংশগ্রহণ করেছিল। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন মেদিনীপুর শহরের অনেক পুজো উদ্যোক্তারাই। যাঁরা অংশগ্রহণ করলেন তাঁরা অবশ্য আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গেই নিজেদের থিম বা কার্নিভালের বিষয়বস্তু তুলে ধরলেন। সুসজ্জিত ট্যাবলো সহযোগে রঙিন পদযাত্রা, শিল্পীদের অনন্য পরিবেশনা- অতিথি ও দর্শকদের মন কাড়লো। ২-৩ ঘন্টার নজরকাড়া এই আয়োজন নিঃসন্দেহে মাতিয়ে রাখলো মেদিনীপুর-খড়্গপুর’কে। কৃষি, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ ও লৌকিক সংস্কৃতি, শান্তি ও সম্প্রীতি, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবেশ, দেশপ্রেম- প্রভৃতি থিমগুলিকেই ফুটিয়ে তুললেন পুজোর উদ্যোক্তারা। তবে, সর্ব-ধর্ম-বর্ণের মিলনস্থল বাংলা’র এই ‘বিশ্বজনীন’ দুর্গোৎসব উপলক্ষে আয়োজিত কার্নিভালের মূল থিম অবশ্যই- ‘একতাই সম্প্রীতি’। মুখ্যমন্ত্রীর ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ স্লোগানটিকেই জেলা প্রশাসন ও জেলার পূজা উদ্যোক্তারা যে মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। রাজপথে মেদিনীপুর আর্ট অ্যাকাডেমির পড়ুয়াদের আল্পনা, শিল্পী প্রশান্ত খাটুয়া’র শিল্প সুষমা মণ্ডিত মঞ্চ নজর কেড়েছিল মেদিনীপুরে। চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা দুই শহরেই ছিলো বাড়তি আকর্ষণ। ছিলো এল ই ডি টিভি এবং অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থাও। তবে, ৫ মিনিট উল্লেখ করে দেওয়া হলেও (বা, ঘোষণা করা হলেও), নিজেদের থিম বা বিষয়বস্তু তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পুজো কমিটি বিভিন্ন সময় নিয়েছেন প্রথমবারের এই পুজো কার্নিভালে!

thebengalpost.net
স্বাস্থ্যই সম্পদ- নিউ খাপ্রেলবাজার (তরুণ সংঘ ব্যায়ামাগার) :

মেদিনীপুর শহরের রবীন্দ্রনগর দুর্গাপূজা কমিটির এবারের পুজোর থিম ছিল, “বাংলার কৃষি ও বাঙালির বাজার।” এককথায় বাংলার গ্রামীণ হাট-কেই তাঁরা তুলে ধরেছিলেন পূজো মণ্ডপে। কার্নিভালেও মাটির কলসি হাঁড়ি বোঝাই করে তাঁদের গরুর গাড়ি প্রবেশ করলো। নেপথ্যে বেজে উঠলো- “কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি…!” অশোক নগর সর্বজনীনের (রেনেসাঁ ক্লাব) থিম ছিল- “এবং শান্তিরূপেণ”। শ্বেত বস্ত্র পরিহিত পুজো কমিটির পুরুষ ও মহিলারা কার্নিভাল থেকেও দিলেন শান্তির বার্তা। রাঙামাটি দিয়েছে সম্প্রীতির বার্তা। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন, পারসিকদের নিয়েই যে ভারতমাতার ভুবন সংসার- কচিকাঁচাদের অনন্য সাজে সেই চিত্র-ই ধরা পড়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বার্তা তুলে ধরলেন একাধিক পুজো কমিটির সদস্যবৃন্দ ও শিল্পীরা। ছিল ডেঙ্গু বার্তা, ব্যাঘ্র সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান। সঙ্গে রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার- প্রভৃতি প্রকল্পগুলিও তুলে ধরলেন মহিলা পরিচালিত একাধিক পুজো কমিটি। রাজাবাজার সর্বজনীনের থিমে ধরা পড়েছে ‘দুর্গা রূপী নারী’র প্রতিদিনের কৃতিত্ব। তাঁদের ট্যাবলো ও পদযাত্রায় ফুটে উঠলো- একদিকে কৃষক রমনী, মহিলা শ্রমিক, মহিলা পুলিশ, শিক্ষিকা হিসেবে; আবার অন্যদিকে জেলাশাসক, মুখ্যমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হিসেবেও মহিলারা সাফল্যের সঙ্গে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। নিউ খাপ্রেলবাজার দুর্গাপূজা কমিটি (তরুণ সংঘ ব্যায়ামাগার) আবার বর্তমান সময়ের অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক “স্বাস্থ্যই সম্পদ” থিমের মধ্য দিয়ে যোগা, খেলাধুলা, শরীরচর্চার বিষয়গুলি তুলে ধরলেন শহরের রাজপথে। তরুণ সংঘের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের ক্রীড়াবিদেরা অংশগ্রহণ করেছিলেন এই কার্নিভাল পদযাত্রায়। খড়্গপুরের কার্নিভালেও পরিবেশ সচেতনতা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা ধরা পড়েছে। শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে স্বাস্থ্যযোদ্ধা তথা করোনা যোদ্ধাদের। খড়্গপুরের মঞ্চ আলো করে একদিকে যেমন ছিলেন অভিনেত্রী তথা শাসকদলের রাজ্য সম্পাদক সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ঠিক তেমনই ছিলেন বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরুরা (হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান) এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের (তৃণমূল ছাড়াও সিপিআইএম, বিজেপি ও কংগ্রেসের) কাউন্সিলররা। খড়্গপুর পৌরসভার পৌরপ্রধান প্রদীপ সরকার তাই বললেন, “খড়্গপুর শহর ‘মিনি ইন্ডিয়া’ হিসেবে খ্যাত, তাই এই শহর কার্নিভাল থেকেও সেই বার্তাই দিয়েছে।” মেদিনীপুরের মঞ্চে ছিলেন জেলাশাসক আয়েশা রানী, জেলা পুলিশ সুপার দীনেশ কুমার, মন্ত্রী মানস রঞ্জন ভুঁইয়া, শ্রীকান্ত মাহাত, বিধায়ক জুন মালিয়া প্রমুখ। মেদিনীপুর পৌরসভার পৌরপ্রধান সৌমেন খানের আশা, “মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্ন আমরা সফল করতে পেরেছি। আশা করছি, পরের বার আরও বড় কার্নিভাল উপহার দিতে পারব শহরবাসীকে।”

thebengalpost.net
স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প :

thebengalpost.net
একতাই সম্প্রীতি- রাঙামাটি:

thebengalpost.net
স্বদেশপ্রেম :

thebengalpost.net
খড়্গপুর:

thebengalpost.net
মেদিনীপুর: