দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৮ এপ্রিল: মাও নামাঙ্কিত পোস্টারে হুমকি ছিল, “৭ দিনের জন্য পিড়াকাটা বাজার বনধ!” বুধবার (২৭ এপ্রিল) ভোরবেলা সেই পোস্টার উদ্ধার হয়েছিল, একেবারে পিড়াকাটা বাজারের কেন্দ্রস্থলে, যাত্রী প্রতীক্ষালয়ের সামনে একটি দোকানের দেওয়ালে। তাতে দুই স্থানীয় তৃণমূল নেতার নামে ‘হুমকি’ ছাড়াও, মাও নেতা কিষেণজির মৃত্যু’র বদলা এবং পিড়াকাটা বাজার ৭ দিন বন্ধ রাখার হুমকি ছিল। কিন্তু, বৃহস্পতিবার, সকাল থেকেই দেখা গেল, পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গল অধ্যুষিত শালবনী ব্লকের পিড়াকাটা বাজার একেবারে স্বাভাবিক। খোলা আছে সমস্ত দোকানপাট, বাজার, ব্যাঙ্ক, স্কুল সবকিছুই। চলছে যাত্রীবাহী বাস-ও। যদিও,‌ বেলা বাড়ার সাথে সাথে অত্যধিক গরমের কারণেই পিড়াকাটা বাজার একটু ফাঁকা ফাঁকা ছিল। তবে, স্থানীয়দের মধ্যে ‘মাওবাদী বনধ’ বা ‘হুমকি পোস্টার’ নিয়ে আপাতভাবে কোনো ভয় বা আতঙ্ক লক্ষ্য করা যায়নি!

thebengalpost.net
পিড়াকাটা বাজার এলাকা, বৃহস্পতিবার দুপুরে (নিজস্ব চিত্র) :

যদিও, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে নজরদারি বা নিরাপত্তা’য় কোনো ত্রুটি রাখা হয়নি। সকাল থেকেই টহল দিয়েছে রাজ্য পুলিশের সশস্ত্র বাহিনী। বাজারে ছিল বন্দুকধারীদের কড়া নজরদারি। ধুলো উড়িয়ে ছুটেছে পুলিশ আধিকারিকদের কনভয়। আর, এই সমস্ত দৃশ্যই অবশ্য এলাকাবাসী-কে ফিরিয়ে দিয়েছে, ১৩-১৪ বছর আগের ভয়াবহ সেই ‘মাওবাদী দিন’ এর স্মৃতি! যখন, একদিকে মাওবাদীদের রক্তচক্ষু আর অন্যদিকে যৌথ বাহিনীর কড়া নজরদারি সাধারণ মানুষকে প্রতিমুহূর্তে এক অজানা আতঙ্কের মধ্যে রাখত। ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকত লালগড়, পিড়াকাটা, ভীমপুর, মধুপুর, গোয়ালতোড়, সারেঙ্গা, ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি, বিনপুর, বাগমুন্ডি সহ সমগ্র জঙ্গলমহলের বাসিন্দারা। তৈরি হয়েছিল অঘোষিত এক অচলাবস্থা। প্রতিদিন বনধ আর মৃতদেহ উদ্ধার! যৌথবাহিনীর টহল। কখনও বা গুলির লড়াই। এ প্রসঙ্গেই উল্লেখ্য যে, গত কয়েক মাসে জঙ্গলমহল ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকায় পড়েছে মাওবাদী (CPI- Maoist) নামাঙ্কিত পোস্টার। পাওয়া গেছে ল্যান্ডমাইনের মতো নানা ধাতব বস্তু! শুধু তাই নয়, মাস তিনেক আগে (২৫ জানুয়ারি, ২০২২) সারা দেশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ মাওবাদী অসীম মণ্ডল ওরফে ‘আকাশ’ এর পশ্চিম মেদিনীপুরের বাড়িতে হানা দেয় ঝাড়খণ্ড পুলিশ। একসময়ে, পিপলস ওয়ারস গ্রুপ (PWG) এবং জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর সংগঠন বৃদ্ধির কাজের সূত্রে অসীম মন্ডলের নাম হয় ‘আকাশ’। সেই মাওবাদী নেতা আকাশের নামে হুলিয়া জারি করে, ঝাড়খন্ড পুলিশের দুই সদস্যের এক প্রতিনিধি দল আদালতের নির্দেশে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনা থানার ফুলচক গ্রামে অর্থাৎ আকাশ ওরফে অসীম মন্ডলের বাড়িতে হাজির হয় গত ২৫ জানুয়ারি। কিষেণজী পরবর্তী মাও আন্দোলনে এই আকাশের বড়সড় ভূমিকা থাকতে পরে বলে বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তার ‘মাথার দাম’ দেওয়া হয়েছে ১ কোটি টাকা! শুধু বাংলা বা ঝাড়খণ্ড পুলিশ নয়, তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগও।

thebengalpost.net
পিড়াকাটা সচল থাকলেও পুলিশের কড়া নজরদারি :

এই পরিস্থিতিতে, রাজ্যের জঙ্গল অধ্যুষিত জেলাগুলোতে কি ফের মাও আতঙ্ক মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে? নাকি পুরোটাই আতঙ্ক ছড়ানোর সুনিপুণ গেমপ্ল্যান? নাকি প্রাক্তন ও বঞ্চিত মাওবাদীদের চাকরি আদায়ের জন্য প্রচ্ছন্ন হুমকি? নাকি চাকরির লোভে নকল মাওবাদীদের দৌরাত্ম্য? পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এখনও অবধি এ রাজ্যের কোথাও মাওবাদী অস্তিত্ব বা মাওবাদী কার্যকলাপ খুঁজে পাওয়া যায়নি! যদিও, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং, বুধবারের (২৭ এপ্রিল) প্রশাসনিক বৈঠক থেকে ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার বিশ্বজিৎ ঘোষ-কে জানিয়েছেন, ঝাড়খন্ড বর্ডার এলাকা থেকে ইতিমধ্যে ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে রাজ্য পুলিশ। তাঁর মতে, বাইরে থেকে এসেই কেউ কেউ এসবে মদত দিচ্ছে। আর, ওদের নিয়ে আসছে প্রাক্তন মাওবাদীরা। যদিও, ৮-১০ হাজার জনকে চাকরি দেওয়া হয়ে গেছে, তবুও যে ক’জন বাকি রয়ে গেছে, তারাই এসব করছে বলে মুখ্যমন্ত্রী’র ধারণা! এদিকে, শাসকদলের নেতা-নেত্রীরা মনে করছেন, পুরোটাই বিজেপির চক্রান্ত।‌ জঙ্গলমহলে ফের আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা। অপরদিকে, বিজেপি মনে করছে, শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা অনুন্নয়ন, কর্মসংস্থান হীনতার ফল! সিপিআইএমের বক্তব্য, শাসকদলের পায়ের তলা থেকে জমি সরে যাচ্ছে, তাই মাওবাদী জুজু দেখিয়ে নিজেদের পকেটে ভোট ঢোকানোর চেষ্টা! পুরোটাই মুখ্যমন্ত্রী’র সাজানো নাটক। এদিকে, পুলিশের গোপন সূত্র বলছে, জঙ্গলমহল জুড়ে যে’কটি পোস্টার দেওয়া বা নকল ল্যান্ডমাইন রাখার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলির বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করা হয়েছে এবং গ্রেফতার করা হয়েছে। আসলে ভীতি বা আতঙ্ক তৈরি করে যে চাকরি (হোমগার্ডের চাকরি) বাগানোটাই মূল উদ্দেশ্য, এটাই পুলিশ প্রশাসন ও শাসকদল একযোগে মনে করছে। তবে, সাধারণ মানুষের মতে, হ্যাঁ, এটা ঠিক যে এখন আর এরাজ্যে মাওবাদী সমস্যা নেই। কিন্তু, কর্মসংস্থানের অভাব, সরকারি চাকরিতে লাগামছাড়া দুর্নীতি, সরকারি প্রকল্পের টাকা নয়ছয়, আদিবাসী ও দারিদ্র্য অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে মানুষের বাসস্থান ও আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন না হওয়া এবং সর্বোপরি, শাসকদলের বহু নেতার ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হয়ে ওঠা-র ঘটনাগুলি নিঃসন্দেহে মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি করেছে। আর, সেই ক্ষোভকেই যে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে ‌বা করবে, তা একপ্রকার নিশ্চিত। সবমিলিয়ে, এই মুহূর্তে, জঙ্গলমহল জুড়ে মাওবাদীদের প্রভাব না থাকলেও, মাওবাদী নিয়ে যে একটা ‘ধোঁয়াশা’ তৈরি হয়েছে তা বলাই বাহুল্য!

thebengalpost.net
বুধবার এই যাত্রী প্রতীক্ষালয়ের সামনেই পাওয়া গিয়েছিল মাওবাদী পোস্টার :