দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৭ জুন: খড়্গপুরের ‘রেল মাফিয়া’ শ্রীনু নাইডু হত্যা মামলায় রেল শহরের আরেক মাফিয়া বাসব রামবাবু সহ ১৩ জনকে উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণাদির অভাবে বেকসুর খালাস করল মেদনীপুর জেলা আদালত। মঙ্গলবার দুপুরে মেদিনীপুর জেলা আদালতের চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা বিচারক মন্দাক্রান্তা সাহা রায় ঘোষণা করেন শ্রীনু হত্যা মামলার। সেখানেই ‘বেনিফিট অফ ডাউট’-এ ‘ডন’ রামবাবু সহ ১৩ জনকেই বেকসুর খালাস করা হয়। যদিও, বিচারকের এই রায়ে একবারেই খুশি নন সরকার পক্ষের আইনজীবী। সরকার পক্ষের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর সমর কুমার নায়েক জানান, “১৩ জন অভিযুক্ত তথা কুখ্যাত এই মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও জানিনা বিচারক কেন পক্ষপাতদুষ্ট (Biased) এমন রায় ঘোষণা করলেন!” তাঁর আশঙ্কা, “এরা জেলের মধ্যে থেকেও যেভাবে নিজেদের লোকেদের দিয়ে শহরে নানা ধরনের অপরাধমূলক বা দুষ্কৃতীমূলক কান্ড ঘটায়, তাতে জেলের বাইরে এলে কি করবে! পুলিশ প্রশাসনও এই সমস্ত দাগি মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এদের বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ ছিল। একেকজনের বিরুদ্ধে ৩০-৩৫টি করে মামলা আছে। তা সত্ত্বেও বিচারকের এই ধরনের রায়ে আমরা হতাশ।” অবিলম্বে উচ্চ আদালতে (কলকাতা হাইকোর্টে) যাওয়ার সমস্ত প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
এই রায়ে স্বাভাবিকভাবেই হতাশ শ্রীনু নাইডু’র স্ত্রী তথা খড়্গপুর পৌরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর এ. পূজা নাইডুও। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি রীতিমতো দিবালোকে (দুপুর ৩টে নাগাদ) খড়্গপুর পৌরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের নিউ সেটলমেন্ট এলাকায় তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে খুন হয়েছিলেন বছর ৩৫’র শ্রীনু! তাঁর সঙ্গে দলীয় কার্যালয়ে বসে থাকা আরেক তৃণমূল কর্মী তথা শ্রীনুর এক সাগরেদও খুন হন। গুরুতর জখম হন আরো ৩ জন। কয়েকজন অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতী বাইকে করে এসে গুলি করে পালিয়ে যায়। দ্রুত তাঁদের উদ্ধার করে প্রথমে মেদিনীপুর মেডিকেল এবং পরে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে খড়্গপুরের কুখ্যাত রেল মাফিয়া শ্রীনু নাইডু’কে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। হামলায় মৃত্যু হয় ২৫ বছরের ধর্মা রাও নামে শ্রীনুর এক সাগরেদেরও। জখম হন ৩ জন। সেই মামলার তদন্তে নেমে খড়্গপুরের আর এক রেল মাফিয়া বাসব রামবাবুকে ২৮ ফেব্রুয়ারি অন্ধ্রপ্রদেশের তানুকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এই জোড়া খুনের ঘটনায় মোট ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনার ৮৭ দিনের মাথায় আদালতে চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। সেই মামলাতেই মেদিনীপুরের চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা বিচারক মন্দাক্রান্তা সাহার এজলাসে মঙ্গলবার ছিল রায় দান। বিচারক রায়ে রামবাবু সহ ১৩ জনকেই বেকসুর খালাস করার নির্দেশ দেন। শ্রীনুর স্ত্রী তথা খড়্গপুর পৌরসভার কাউন্সিলর পূজা জানান, “দু’জন মানুষ খুন হয়ে গেলেন। আহত হলেন আরও মানুষ। কিন্তু, রায়ে সকলকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হল! আমরা রায়ের কপি হাতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। রায় দেখে উচ্চতর আদালতে যেতে পারি।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে খড়্গপুরের ত্রাস ছিলেন বাসব রামবাবু। রেলের ছাঁট লোহার কারবারের কোটি কোটি টাকা থেকেই ‘রেলশহর’ খড়্গপুরের ‘বেতাজ বাদশা’ হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর, রেলের ঠিকাদারি নিয়ে শত্রুতা থেকে তাঁর হাতে যথাক্রমে ১৯৯৯ ও ২০০১ সালে খুন হতে হয় সিপিআই নেতা নারায়ণ চৌবের দুই ছেলে যথাক্রমে মানস চৌবে ও গৌতম চৌবেকে। সেই মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয় রামবাবুর। রামবাবু জেলে যাওয়ার পর থেকেই খড়্গপুরের ‘রেল মাফিয়া’ হিসেবে নতুন ‘ত্রাস’ হয়ে ওঠেন একদা তাঁর ঘনিষ্ঠ শ্রীনু। এরপর, ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট থেকে শর্তাধীন জামিন নিয়ে আসেন রামবাবু। একই শহরে দুই মাফিয়ার রেষারেষিতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে রামবাবুর উপরে শ্রীনু হামলা চালায় বলে অভিযোগ। কিন্তু, বেঁচে যান রামবাবু। ওই মামলাতে জামিনও পেয়ে যান শ্রীনু। এরপরই, রাজনীতিতে আসেন শ্রীনু। নাম লেখান বিজেপিতে। ২০১৫ সালের পৌর নির্বাচনে তাঁর স্ত্রী পূজা নাইডু ১৮ নং ওয়ার্ডের বিজেপি কাউন্সিলর হন। অভিযোগ, সেই সময় পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষই তৃণমূলকে পরিচালনা করতেন! তাঁর অঙ্গুলি হেলনেই নাকি পূজা তৃণমূলে যোগ দেন। শ্রীনুও হয়ে ওঠেন শাসকদলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কর্মী! খড়্গপুরের রেল সাম্রাজ্যে রামবাবুও হারিয়ে যেতে থাকেন। তবে, শ্রীনুর এই রকেট গতিতে উত্থানে নাকি ক্রমশ চাপে পড়তে হচ্ছিল শাসকদলকেও। এর পর পরই, ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি নিজের কার্যালয়ে বসেই খুন হতে হয় শ্রীনুকে! শ্রীনুর দাপটে মাফিয়া জগতে পিছিয়ে পড়া রামবাবুকে গ্রেপ্তার করা হয় অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। এবার, উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণাদির অভাবে বেকসুর খালাস হলেন বাসব রামবাবু সহ ১৩ জন। খুনের সমস্ত তথ্য-প্রমাণ সহ উচ্চ-আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সরকারপক্ষের আইনজীবী।