Paschim Medinipur

Medinipur: পশ্চিম মেদিনীপুরের স্কুলে আছে পড়ুয়াদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক! আছে হাসপাতাল সহ আরও কত কী

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২১ মে: একটি কাঁচের আলমারি। তার উপরে বড় বড় করে লেখা ‘ব্যাঙ্ক’। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ৫টি তাক। আর তাতেই থরে থরে সাজনো প্লাস্টিকের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ বা টাকা রাখার ভাঁড়! প্রতিটি ভাঁড়ে লেখা আছে ছাত্রছাত্রীদের নাম। সঞ্জনা, রুবিনা, সৌমি, আফরিন, মানস, সাইনা-রা ভাঁড় হাতে নিয়ে জানায়, “এতে আমরা প্রতিদিন এক টাকা- দু’টাকা করে জমাই!” স্কুলের এই অফিস রুম থেকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেই বারান্দার একটি নিরাপদ স্থানে রাখা আছে একটি খাট বা শয্যা। মাথার উপরে একটি টেবিল ফ্যান। স্কুলের মধ্যে বিছানা কেন? দেওয়ালে বড় বড় করে লেখা ‘শুশ্রুষা হাসপাতাল’। বিভিন্ন তাকে রাখা আছে ‘ফার্স্ট এইড বক্স’ সহ নানা ওষুধপত্র। হাসপাতালের পরেই আছে ‘স্বাবলম্বী’ কক্ষ। সেখানে রাখা আছে সেলাই মেশিন। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই ছোট্ট ও সুন্দর একটি অডিটোরিয়াম। আছে টিভি, প্রজেক্টর। না কোনও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। এটি আসলে একটি সরকার পোষিত প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছবির মতো সাজানো এই বিদ্যালয়ে খানিকটা বেসরকারি স্কুলের ধাঁচেই সম্প্রতি হয়ে গেল দশ দিনের ‘সামার ক্যাম্প’-ও। খড়গপুর গ্রামীণের হিজলি সংলগ্ন কুচলাচাটি এলাকায় অবস্থিত সেই কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়-কেই জেলার অন্যতম এক মডেল স্কুল হিসেবে তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ (DPSC)।

নিজেদের লক্ষ্মীর ভান্ডার হাতে কন্যাশ্রীরা:

বিজ্ঞাপন (Advertisement):

কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়: সম্প্রতি, সমগ্র শিক্ষা মিশনের উদ্যোগে জেলাব্যাপী যে ‘শিখন শিক্ষণ উপকরণ’ (TLM) প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে জেলার প্রায় সাড়ে ৩ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ‘প্রথম স্থান’ অধিকার করেছে এই স্কুল। নানা অভিনব উদ্যোগ, পড়াশোনার মান, ছাত্রছাত্রীদের দক্ষতা-সক্রিয়তা সহ স্কুলের সার্বিক পরিকাঠামোর উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে এই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা (TIC) তনুশ্রী দাস-কে রাজ্য সরকারের তরফে ‘শিক্ষারত্ন‘ পুরস্কারে ভূষিত করা হয় ২০২০ সালে। ২০২২ সালে কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সরকারের ‘স্বচ্ছ বিদ্যালয় পুরস্কার’ সম্মান অর্জন করে। ২০২৩ সালে রাজ্য সরকারের ‘নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার’-ও পায় এই স্কুল। স্কুলের প্রতিটি ক্লাসরুমেই রাখা আছে বিষয়ভিত্তিক অসংখ্য শিক্ষা উপকরণ বা টিচিং লার্নিং ম্যাটেরিয়াল। যা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তত্ত্বাবধানে ছাত্রছাত্রীরাই তৈরি করেছে। ক্লাসরুমের সিলিং বা ছাদেও রয়েছে নানা কারুকার্য তথা বিষয়ভিত্তিক ছবি ও মডেল। যেমন, কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল প্রভৃতি।

শুশ্রুষা হাসপাতাল:

ব্যাঙ্ক ও হাসপাতাল: স্কুলের বিশেষ বা অভিনব দুই উদ্যোগ হল- ‘চিলড্রেন্স ব্যাঙ্ক’ এবং ‘শুশ্রুষা হাসপাতাল’। তনুশ্রী ম্যাডাম বলেন, “প্রত্যন্ত এই এলাকার ছাত্রছাত্রীরা মূলত আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া বা দিনমজুর পরিবার থেকেই আসে। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করার পর উপলব্ধি করি, ওই ছাত্রছাত্রীরা যখন আমাদের স্কুল থেকে বেরিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হতে যায়, সামান্য ভর্তির টাকাটুকু বা বইপত্র কেনার টাকাও থাকেনা। অথচ, ওদেরই আমরা দেখি প্রতিদিন ১টাকা, ২টাকা বা ৫টাকা দিয়ে কিনে চকলেট, চিপস বা চানাচুর খেতে। তখনই ঠিক করি, এরা যদি প্রতিদিন এই এক টাকা, দু’টাকা করে জামাতে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণী (বর্তমানে, পঞ্চম শ্রেণী) পাস করার পর যেটুকু টাকা জমবে, তাতে হাইস্কুলে ভর্তি কিংবা কিছু বইপত্র কেনার টাকা হয়ে যাবে। সেই ভাবনা থেকেই ২০১৭ সালে প্রত্যেকের জন্য একটি করে প্লাস্টিকের ভাঁড় (লক্ষ্মীর ভান্ডারও বলা যায়) কেনার ব্যবস্থা করি। অফিস রুমে একটি কাঁচের আলমারিতে সেই ভাঁড় সাজিয়ে রাখা আছে। শিশু সংসদের ছেলেমেয়েরাই তা দেখভাল করে। ওই ভাঁড়ে ওরা ওদের সুবিধামতো ১টাকা, ২টাকা, ৫টাকা করে জমায়। আমরা এর নাম দিয়েছি, ‘চিলড্রেন্স ব্যাঙ্ক অফ কেপিএস’!” ছাত্রছাত্রীদের সেই জমানো টাকাই যে মাঝেমধ্যে তাঁদের পরিবারের বিপদের সময়ও কাজে লাগে, তাও জানান স্কুলের শিক্ষিকা গৌরী বেরা, অনামিকা অট্ট প্রমুখ। তাঁরা তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী রুবিনা খাতুনের উদাহরণ তুলে ধরেন। একদিন দুপুরে হঠাৎই রুবিনার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাড়ির পাশেই স্কুলে পৌঁছলে রুবিনা ছুটে যায়। ফের স্কুলে এসে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকাকে বলে, “ম্যাডাম আমার ওই ভাঁড়ের টাকাটা পাওয়া যাবে? মা-কে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।” সম্মতি দিয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা। রুবিনা বলে, “ওই টাকা দিয়েই তো মাকে ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধ কিনেছিলাম।”

ছাত্রছাত্রীদের সাথে শিক্ষিকা:

আবার, ছেলেমেয়েরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার কথা ভেবেই এই হাসপাতালের ভাবনা বলে জানিয়েছেন কুচলাচটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এছাড়াও, ছাত্রছাত্রীদের ‘মনের কথা’ শোনার জন্য আছে ‘কানে কানে বলো’ নামে একটি বাক্সও। ছাত্রছাত্রীরা চিঠি লিখে তাদের মনের কথা বলে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা তার সমাধান করার চেষ্টা করেন। ছাত্রছাত্রীদের মন ভালো রাখার জন্য এবং সুশিক্ষা দেওয়ার জন্য স্কুলে সবজির বাগান বা কিচেন গার্ডেন ছাড়াও ফলের বাগান, ভেষজ উদ্যান গড়ে তোলা হয়েছে। গরমে পাখিদের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য বাগানের গাছগুলিতে জলের পাত্র ঝোলানো হয়েছে। সম্প্রতি, কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাতে এই প্রজেক্টর তুলে দিয়েছেন স্কুলের এক শুভানুধ্যায়ী তথা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকার এক পরিচিতা। ঠিক একইভাবে স্কুলের পরিকাঠামোতে মুগ্ধ হয়ে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীই স্কুলের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দিয়েছেন টিভি, স্বয়ংক্রিয় বেল, চেয়ার, সোফা, দোলনা সহ নানা জিনিসপত্র। এমনটাই জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা তনুশ্রী দাস। তিনি এও বলেন, “বেশকিছু কাজ এবং বিল্ডিংগুলি সরকারি তহবিলের অর্থে করতে পেরেছি। তবে, আমার সহকর্মী সহ শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও প্রচুর সাহায্য পাই।” স্কুলের শিক্ষিকা গৌরী বেরা, শিক্ষক প্রসেনজিৎ গিরি বলেন, “আমাদের অনুপ্রেরণা তো টিআইসি ম্যাডামই। উনি নিজের ‘শিক্ষারত্ন’ পুরস্কারের সম্পূর্ণ অর্থমূল্য (২৫ হাজার টাকা)-ই স্কুলকে তুলে দিয়েছেন।” পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারম্যান অনিমেষ দে বলেন, “সদিচ্ছা থাকলে সরকারি বা সরকার পোষিত প্রাথমিক বিদ্যালয়কেও যে এভাবে গড়ে তোলা যায়, তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ হল, কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্কুলের শিক্ষা উপকরণ, শ্রেণীকক্ষ সহ নানা বিষয়গুলি আমরা মডেল হিসেবে তুলে ধরতে চাই। সেই উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। সেই সঙ্গে আগামীদিনে স্কুলের পাশে থাকার আশ্বাসও আমরা দিয়েছি।”

দেওয়ালে নানা কারুকার্য:

স্কুলের প্রবেশপথে:

News Desk

Recent Posts

Midnapore: মানবসেবার ব্রত নিয়ে ৫৩-তেও ছুটে চলেছেন মেদিনীপুরের অনয়; জন্মদিনে রক্তদানের সঙ্গেই পড়ুয়াদের জন্য পানীয় জলের মেশিন

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৯ জুলাই: মানবসেবার ব্রত নিয়ে ছুটে চলেছেন ৫৩ বছরের…

2 days ago

IIT Kharagpur: ফের IIT খড়্গপুরের মেধাবী ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যু, উদ্ধার ঝুলন্ত দেহ! চলতি বছরেই আত্মঘাতী চার পড়ুয়া

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৮ জুলাই: গত ৪ মে-র পর ১৮ জুলাই। মাত্র…

3 days ago

Midnapore: “আমরা দু’জনে ভাসিয়া এসেছি…!” অঞ্জলির মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পরই বিদায় নিলেন সুনীলও, মেদিনীপুরের মাটিতেই বিরল প্রেমগাথা

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৭ জুলাই: "আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি/ যুগল প্রেমের স্রোতে/…

5 days ago

Midnapore: মদ্যপান করতে বসে বচসা, কেশিয়াড়ি BDO অফিসের বড়বাবুকে খুন করলেন কলেজ পড়ুয়া যুবক

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৬ জুলাই: কেশিয়াড়ি বিডিও অফিসের হেডক্লার্ক কাম অ্যাকাউন্টেন্ট (বড়বাবু)…

6 days ago

Medinipur: খুনের আসামি থেকে মাটির মানুষ, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তিন প্রৌঢ় মুক্তি পেলেন মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার থেকে

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৩ জুলাই:'দস্যু' রত্নাকর যদি 'মহাকবি' বাল্মীকি হয়ে উঠতে পারেন,…

1 week ago

Midnapore: অপু-দুর্গার মতোই ট্রেন দেখতে বেরিয়েছিল ওরা, তারপরই নিখোঁজ! সিনেমার স্টাইলে উদ্ধারাভিযান ডেবরা পুলিশের

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৩ জুলাই: "এক কাজ করবি অপু, চল যাই আমরা…

1 week ago