Special Article

Midnapore: পশ্চিম মেদিনীপুরের পর্যটন মানচিত্রে নতুন গন্তব্য! মোগলমারির কাছেই ঐতিহাসিক ‘নাট্যশালা’ সংস্কার করল প্রশাসন

দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৯ মার্চ: ৪৫০ বছরের পুরনো মোঘল যুগের রাজবংশ। প্রায় ১০০ বছরের পুরনো তার নাট্যশালা। দাঁতনের গড়-মনোহরপুরে ইন্দো-গ্রীক ঘরানায় তৈরি মিনার, তোরণ, প্রাচীন মন্দির, বিগ্রহ এবং সুবিশাল এক রাজবাড়ি নীরবে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। দাঁতনে মোগলমারি বৌদ্ধবিহার ভ্রমণে এলে পর্যটকেরা কি কেউ কোনদিন এই রাজবাড়ির প্রাচীন নাট্যশালা ঘুরে আসার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন? স্বাধীনতার পর থেকেই লোকচক্ষুর আড়ালে ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই রাজবাড়ি। দীর্ঘদিন ধরে বিষাক্ত সাপের আস্তানা। ঘন জঙ্গলে ঘেরা প্রাঙ্গণে যেন ঘুমিয়ে ছিল একটি যুগের ইতিহাস। কিন্তু, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শিক্ষক তথা আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোক সংস্কৃতির একনিষ্ঠ গবেষক সন্তু জানা’র প্রচেষ্টায় সেই ঐতিহাসিক ক্ষেত্র এখন জেলার অন্যতম পর্যটনক্ষেত্র রূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস প্রসিদ্ধ দাঁতনের অপ্রকাশিত ইতিহাসকে আলোকিত করার নেশায় নিভৃতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সন্তু। মোগলমারির বৌদ্ধবিহার থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে, গড়-মনোহরপুরের রাজবাড়ি প্রসঙ্গে বহু অজানা কথা, শিহরণ জাগানো ইতিহাস সন্তু বাবু তাঁর সদ্য প্রকাশিত গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘সেকালের দাঁতন : অনালোকিত ৩০০ বছরের কথা ও কাহিনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘দণ্ডভুক্তি একাদেমি’ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। সংবাদপত্রে নিয়মিত খোলা চিঠি লিখেছেন। অবশেষে, প্রশাসনের সুনজরে পড়ে পরিত্যক্ত রাজবাড়ির প্রাচীন নাট্যশালার উপর। সকলে মিলে চেষ্টা চলে ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার, বাঁচিয়ে রাখার। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই পর্যটকদের জন্য খুলে গেছে ঐতিহ্যবাহী রাজা রামচন্দ্র নাট্য মন্দিরের দরজা।

ঐতিহাসিক নাট্যশালা :

দাঁতনের মনোহরপুর রাজবংশের ইতিহাস বহু প্রাচীন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে, ১৫৭৫ সালের ৩ মার্চ সুবর্ণরেখা নদী তীরবর্তী দাঁতনের টুকারুই, মোগলমারি, নহঞ্জরা প্রভৃতি গ্রামে বেজে ওঠে মোঘল-পাঠান মহাযুদ্ধের দামামা। সম্রাট আকবরের সেনাপতি টোডোরমল ও মুনিম খাঁর নেতৃত্বে সুবিশাল মোঘল বাহিনী পর্যুদস্ত করে অত্যাচারী পাঠান নবাব দাউদ খান কররানীকে। বাংলার ইতিহাসে সূচিত হয় এক নতুন যুগ। মোঘল বাহিনীর জনৈক বিজয়ী সেনাধ্যক্ষ লছমিকান্ত সিংহ উত্তর রাও যুদ্ধ শেষে আর দিল্লি ফিরে যাননি। দাঁতনেই থেকে যান। তিনিই দাঁতন রাজবংশের প্রথম পুরুষ। দিল্লির দরবার থেকে এঁরা বংশ পরম্পরায় লাভ করেছিলেন ‘বীরবর’ উপাধি। ১৮৪৮ সালে বংশের দ্বাদশ পুরুষ রাজা রামচন্দ্র রায় বীরবর জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার ও সমাজসেবক । কলকাতার ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে সাম্মানিক সদস্যপদ লাভ করেছিলেন তিনি। ১৮৬৮ সালে তাঁর অসামান্য উদ্যোগে দাঁতনে প্রতিষ্ঠিত হয় মিডল-ইংলিশ স্কুল, যা আজকের ‘দাঁতন হাইস্কুল’ নামে সর্বজনবিদিত। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে তাঁর অদম্য প্রচেষ্টায় দাঁতনের প্রথম দাতব্য চিকিৎসালায়, সাপ্তাহিক হাট, কালিচন্ডী মন্দির প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ওড়িশা ট্রাংক রোড সম্প্রসারণ ও মুন্সেফ কোর্ট সংস্কার প্রভৃতি কাজে বৃটিশকে বিনাশর্তে জমি দান করেন তিনি। রাজা রামচন্দ্র প্রায় ৫০ বছর ধরে নাট্য চর্চায় ব্রতী ছিলেন। ১২৮৬ বঙ্গাব্দে গড়ে তোলেন সখের যাত্রাদল। রচনা করেছিলেন অসংখ্য পৌরাণিক পালাগান। ১৯২৬ সালে গড়-মনোহরপুর গ্রামে পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে ‘সাহিত্যভূষণ’ সুরেশ চন্দ্র রায় বীরবর গড়ে তুলেছিলেন একটি ত্রিতল বিশিষ্ট সুবিশাল নাট্যমঞ্চ ও পেক্ষাগৃহ। নিচের তলায় সাজঘর, ওপরে আলোকসজ্জা ও মাঝে ঘূর্ণায়মান মঞ্চে হত মূল অভিনয়। নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ী এসে অভিনয় করে গিয়েছেন। কলকাতার স্টার থিয়েটার ও চিৎপুরের বহু শিল্পীর পদধূলি পড়েছে এইমঞ্চে। প্রতি বছর লোকসমাগমে সম্পন্ন হত নাট্য উৎসব। সঙ্গীতপ্রেমী মনোহরপুর রাজবাড়ির রাজকুমার ক্ষিতিশ চন্দ্রের সঙ্গে বিবাহ হয় সুদূর ত্রিপুরার রাজকুমারী লতিকার। সেই সূত্রে দাঁতন থানায় অবস্থিত এই রাজবাড়িতে এসেছিলেন ললিতার দাদা তথা প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীত পরিচালক ও গায়ক শচীন দেব বর্মণ। ১৯৪২ সালের বিধ্বংসী সাইক্লোনে ধূলিসাৎ হয়ে যায় ‘রাজা রামচন্দ্র নাট্য মন্দির’।

ঐতিহাসিক ক্ষেত্র:

ঐতিহাসিক মিনার, দেখাচ্ছেন সন্তু (ডান দিকে) :

এ সমস্ত আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক সন্তু জানা তাঁর বইতে স্থান দিয়েছিলেন। বর্তমান নাট্যমন্দির প্রাঙ্গণে ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য যে পাথরের ফলক বসেছে, সেটিও তাঁরই রচনা। তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে দাঁতনের অরক্ষিত ইতিহাস ক্ষেত্রগুলি সংরক্ষণ করার বিষয়ে আবেদন করেছি প্রশাসনের কাছে। অবশেষে আমাদের লড়াই কিছুটা হলেও সফল হল। বর্তমান বিডিও সাহেবের সদিচ্ছাতেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। আনন্দ আজ সীমাহীন।” সম্প্রতি, দাঁতন-১ পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগে প্রাচীন নাট্যমন্দির সংস্কার করে অখণ্ড মেদিনীপুর জেলাবাসীর কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। মনোহরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত স্মৃতি সংরক্ষণ সমারোহে উপস্থিত ছিলেন দাঁতনের বিধায়ক বিক্রম চন্দ্র প্রধান, কেসিয়াড়ির বিধায়ক পরেশ চন্দ্র মুর্মু, দাঁতন-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অনন্ত মান্ডি, সহ-সভাপতি কনক পাত্র, দাঁতন-১ সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক চিত্তজিৎ বসু, রাজবাড়ির অন্যতম শরিক দেবাশীষ রায় বীরবর, ক্ষৌনিশ চন্দ্র রায় বীরবর, তীর্থঙ্কর রায় বীরবর প্রমুখ। এছাড়াও ছিলেন, অবন্তী জানা, অতুল কৃষ্ণ রায়, শান্তিপদ দাস, পবিত্র পাত্র, ঝন্টু দাস, অনিমেষ বেরা, শিবশঙ্কর সেনাপতি, কুন্তল দাস প্রমুখ দণ্ডভুক্তি একাদেমির সদস্যরা। তবে, সকলকে অবাক করে দিয়ে এই সংস্কারের মূল উদ্যোক্তা দাঁতন-১ বিডিও চিত্তজিৎ বসু তাঁর বক্তব্যে বলেন, “আমাকে উৎসাহিত করার পেছনে যিনি মূল কারিগর তিনি হলেন সন্তু জানা।”

সংস্কারের পথে:

প্রশাসনের আধিকারিকদের সঙ্গে সন্তু জানা (দ্বার উন্মুক্ত হওয়ার দিনে) :

News Desk

Recent Posts

Vidyasagar University: আবহাওয়ার নিখুঁত খবর জানতে ISRO-র সহযোগিতায় আকাশে যন্ত্র লাগানো বেলুন পাঠাল বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৩ জুন: রবিবার (২২ জুন) দুপুর ঠিক ২টো ১…

19 hours ago

Midnapore: “১৯৭৮-এর পর এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেনি গড়বেতা!” আসরে NDRF-SDRF; প্লাবন পরিস্থিতি চন্দ্রকোনাতেও

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২০ জুন: ১৯৭৮ সালের পর এমন ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির…

4 days ago

Midnapore: মিয়াজাকি, ব্ল্যাকস্টোন থেকে আম্রপালি, হিমসাগর; মেদিনীপুরে জমজমাট ‘আম উৎসব’

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৮ জুন: ৩০ টাকা প্রতি কেজি থেকে ৩ লক্ষ…

6 days ago

Kharagpur: খড়্গপুরের কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ! মৃত্যু এক শ্রমিকের

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, খড়্গপুর, ১৭ জুন: গ্লিসারিন কারখানায় ওয়েল্ডিং- এর কাজ চলাকালীন ভয়াবহ বিস্ফোরণ!…

1 week ago

Midnapore: প্রায় দু’দশক পরে পশ্চিম মেদিনীপুরে শুরু হয়েছিল প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া; থমকে গেল আদালতের নির্দেশে

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৬ জুন: ২০০৮ এর পর ২০২৫। দীর্ঘ প্রায় দুই…

1 week ago

Elephant: হাতির পালকে তাক করে ছোঁড়া হচ্ছে একের পর এক জ্বলন্ত হুলা; নেটমাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে পড়তেই নিন্দার ঢল

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, খড়্গপুর, ১৩ জুন: হাতির পালকে তাক করে ছোঁড়া হচ্ছে একের পর…

2 weeks ago