দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৬ সেপ্টেম্বর: বিশাল জায়গার উপর প্রাসাদোপম বাড়ি। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। দুর্ভেদ্য লোহার ফটক। গোটা বাড়িটাই সিসিটিভি দিয়ে মোড়া। তবে, একে বাড়ি না বলে ‘হাজারদুয়ারী’ বললেও অত্যুক্তি হয়না! একতলার (গ্রাউন্ড ফ্লোরের) বিভিন্ন দিকে অন্তত ১০-১২টি দরজা। একতলায় অবশ্য কেউ থাকেন না। মালিক সহ বাড়ির সদস্যরা থাকেন দোতলা ও তিনতলায়। বাড়ির সামনে (পাঁচিলের ভেতরে) সবসময়ই দাঁড়িয়ে থাকে চার-পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়ি। আছে সুবিশাল গ্যারেজও। বাড়ির পেছনে আছে সুইমিং পুল ধাঁচের বিশাল পুকুর। পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদার স্বর্ণ ব্যবসায়ী কৌশিক কর্মকারের চক্ষু ছানাবড়া করা এই বাড়ির ভিডিও এখন সমাজমাধ্যমে ভাইরাল (সত্যতা যাচাই করেনি বেঙ্গল পোস্ট)। আর কৌশিক? গত প্রায় দু’সপ্তাহ আগেই সপরিবারে ‘ফেরার’ হয়েছেন। ‘পলাতক’ বললেও অবশ্য ভুল হয়না! কোটি কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগে সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) বেলদা বাজারের উপর অবস্থিত কৌশিকদের তিন পুরুষের সোনার দোকান ‘সিল’ করা হয়েছে আদালতের নির্দেশে। সোমবার দুপুরে বিডিও এবং ওসি-র উপস্থিতিতে বন্ধ থাকা দোকান পুলিশের তরফে ‘সিল’ করে দেওয়া হয়। গত ১২ দিন (৩ সেপ্টেম্বর) ধরেই অবশ্য দোকানটি বন্ধ ছিল।


পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এখনও পর্যন্ত দায়ের হওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতারণার পরিমাণ প্রায় ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা। সমস্ত অভিযোগ জমা পড়লে ২০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে পুলিশের অনুমান। শুধু তাই নয়, অতি সম্প্রতি কৌশিক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকেও প্রায় ৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। প্রতারণার এই বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আসে গত ২ সেপ্টেম্বর নাগাদ। ওই দিন সন্ধ্যায় গীতাঞ্জলি কামিল্যা নামে এক মহিলা বেলদা বাজারের উপর অবস্থিত কৌশিক কর্মকারের ডি.এন ব্রাদার্স জুয়েলার্সে গিয়ে প্রতারণার পর্দা ফাঁস করেন ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে। পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার বাসিন্দা ওই মহিলা নিজেও লক্ষাধিক টাকার প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন। সেইসঙ্গেই দোকানে উপস্থিত একাধিক প্রতারিত ব্যক্তির বয়ানও তুলে ধরেন তিনি। ওইদিন অবশ্য দোকানে কৌশিক ছিলেন না। অভিযোগ, আগেই তিনি গা ঢাকা দিয়েছিলেন। সেইসময় দোকানে ছিলেন কৌশিকের স্ত্রী ও দিদি। সমস্ত অভিযোগের পরও তাঁরা নীরব ছিলেন। পরের দিন অর্থাৎ ৩ সেপ্টেম্বর সকালে গীতাঞ্জলি কামিল্যা সহ প্রতারিত প্রায় ১০-১২ জন পৌঁছে যান কৌশিকের বেলদার বাড়িতে। সেখান থেকে ফের ফেসবুক লাইভ করেন গীতাঞ্জলি। সিসিটিভি-তে মোড়া রাজপ্রাসাদের মত বাড়ির একতলায় কেউ না থাকলেও, দোতলায় কৌশিকের মা, স্ত্রী ও দিদি ছিলেন বলে দাবি করা হয়। তবে, তাঁরা কোনও সাড়া দেননি দুর্গের মতো বাড়ির ওপর থেকে!

কৌশিকের বিরুদ্ধে বেলদা থানায় প্রথম অভিযোগ দায়ের হয় গত ৭ সেপ্টেম্বর, রবিবার। পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল সামন্ত অভিযোগ দায়ের করেন, গত ফেব্রুয়ারিতে কৌশিক কর্মকার সপরিবারে কোলাঘাটে তাঁর বাড়িতে গিয়ে সোনার গহনা কেনার বিষয়ে চুক্তি করে আসেন। সেই মোতাবেক চলতি বছরের ১২ মার্চ বেলদাতে গিয়ে প্রায় আড়াই কেজি সোনার গহনা দিয়ে আসেন তিনি। যার বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ৫৮ লক্ষ ৬৬ হাজার ৫০০ টাকা। গোপালের অভিযোগ, জুন মাসে দুই কিস্তিতে ৩৫ লক্ষ টাকা পাঠালেও, তারপর থেকে বারবার কৌশিকের দোকানে ও বাড়িতে গিয়ে খালি হাতে ফিরতে হয় তাঁকে। গোপাল জানান, দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর ধরেই সোনার লেনদেন চলছিল। হঠাৎ করে ২০২৩ সালের শেষের দিকে কৌশিকের বাবা অশোক কর্মকার মারা যাওয়ার পর থেকে সমস্যার সূত্রপাত! ঠিক একইভাবে অভিযোগ দায়ের করেন বাঁকুড়ার সুদেষ্ণা মন্ডলও। সুদেষ্ণার অভিযোগ, কয়েক লক্ষ টাকা নেওয়ার পরও সোনার গহনা ডেলিভারি দেননি কৌশিক। সুদেষ্ণার মত একই অভিযোগ, দুই মেদিনীপুর ও বাঁকুড়ার শতাধিক ব্যক্তির। কারুর কাছ থেকে রেকারিং সিস্টেমে গয়না গড়িয়ে দেওয়ার নামে আবার কারুর কাছ থেকে পুরানো সোনার বিনিময়ে নতুন গহনা গড়িয়ে দেওয়ার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা প্রতারণা করেছিলেন। পুলিশেরই একটি সূত্রে জানা গেছে, এগরার এক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় সাড়ে তিন কেজি (বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা) ওজনের সোনার গহনা কেনার পর এক টাকাও মেটাননি কৌশিক। তাঁরা সকলেই একে একে বেলদা থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা শুরু করেছেন। আপাতত গোপাল ও সুদেষ্ণার করা মামলার ভিত্তিতে দাঁতন আদালত গত শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) নির্দেশ দেয়, ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে দোকান সিল করতে হবে। পুলিশকে উপযুক্ত তদন্তের নির্দেশও দেয় আদালত। সেইমতোই সোমবার দুপুরে নারায়ণগড়ের বিডিও কৌশিক প্রামাণিকের উপস্থিতিতে বেলদা থানার পুলিশ দোকান সিল করে। অভিযোগ দায়েরের পর তদন্ত নেমে পুলিশ জানতে পারে, বিগত কয়েক মাস ধরেই দোকানে আসছিলেন না বছর ৪০-এর কৌশিক। তাঁর স্ত্রী, মা ও দিদি দোকান সামলাচ্ছিলেন। কৌশিকের এক নাবালক সন্তানও আছে। ৩ সেপ্টেম্বরের পর থেকেই বাড়ির সকলে ‘উধাও’ হয়ে যান। তদন্তে পুলিশ খতিয়ে দেখছে, গত কয়েক বছর ধরে কৌশিক কি পরিকল্পনামাফিকই প্রতারণার ছক সাজিয়েছিলেন? কৌশিকের সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি এবং গত কয়েক বছরে তাঁর আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। পরিবারের সদস্যদের খোঁজেও শুরু হয়েছে তল্লাশি। যদিও, কৌশিক সহ সকলেরই মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় এখনও পর্যন্ত লোকেশন ট্র্যাক করা সম্ভব হয়নি বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। কৌশিকের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-পরিজনদের প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলেও জেলা পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে। গণেশ জৈন, রাজু চন্ডক, সমীর জানা প্রমুখ বেলদাবাসী বলেন, “ওঁদের তিন পুরুষের ব্যবসা। কৌশিকের বাবা অশোক কর্মকার এলাকার স্বনামধন্য স্বর্ণ ব্যবসায়ী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরই এই অবস্থা!” জেলা পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার বলেন, “তদন্তে সবদিকই খতিয়ে দেখছি আমরা। ওঁদের খোঁজে তল্লাশিও শুরু করা হয়েছে।”











