দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৫ ডিসেম্বর: পারিবারিক বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে, বন্ধুর বাবাকে ‘নিজের বাবা’ দেখিয়ে ভোটার, আধার, প্যান কার্ড বানানোর অভিযোগ। শুধু তাই নয়, বন্ধুর বাবার ভোটার কার্ড ব্যবহার করে, তাঁর ছেলে সেজে এসআইআর-এর ফর্ম (এনিউমারেশন ফর্ম) পূরণও করলেন। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ির সেখ তাজউদ্দিন রাতারাতি হয়ে গেলেন নারায়ণগড়ের বাবলু সিংহ! বিস্ফোরক অভিযোগ ঘিরে উত্তাল পশ্চিম মেদিনীপুর। ইতিমধ্যেই সবং থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন ‘প্রতারিত’ সিংহ পরিবার। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে ‘দত্তক নেওয়ার’ গল্প ফেঁদেছেন বাবলু ওরফে তাজউদ্দিন।

thebengalpost.net
সত্যচরণ সিংহ:

thebengalpost.net
বিজ্ঞাপন (Advertisement):

জানা যায়, পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং থানার খড়পাড়া এলাকার বাসিন্দা প্রতাপ সিংহ খড়্গপুরের একটি কারখানায় কাজ করতেন। ওই এলাকায় জমি কেনাবেচার কারবারের সাথে যুক্ত ছিলেন কেশিয়াড়ির গোপালপুরের বাসিন্দা সেখ তাজউদ্দিন ওরফে বাবলু। ২০২০ সাল নাগাদ তাঁর কাছ থেকে একটি জমি কেনার বিষয়ে কথা হয় প্রতাপের। নিজের (বাবার ভোটার কার্ড সহ) সমস্ত ডকুমেন্টসও তাজউদ্দিনকে দেন প্রতাপ। সেই সূত্রেই প্রতাপের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাজউদ্দিনের। এদিকে, ২০২০ সালের শেষের দিকে প্রতাপের ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রতাপকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় তাঁর পরিবার। সেই সময়ই প্রতাপের বাবা সত্যচরণ সিংহের ভোটার কার্ড ব্যবহার করে, নারায়ণগড় থানার মকরামপুর এলাকার গোবিন্দপুরের ঠিকানায় ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড বানিয়ে ফেলেন তাজউদ্দিন। নিজের নাম দেন- বাবলু সিংহ। বাবার নাম- সত্যচরণ সিংহ। ২০২১ সালে প্রতাপ যখন গুরুতর অসুস্থ, হঠাৎই তাজউদ্দিন একদিন প্রতাপের বাবা সত্যচরণকে বিষয়টি জানান। সত্যচরণ বাবু সেইসময় তাজউদ্দিনকে বলেন, ‘এখন আমার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা! পরে এই বিষয়ে কথা বলব।’ বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও বিষয়টি জানতেন। তবে, তখনকার মতো বিষয়টি সেখানেই ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০২২ সালের আগস্ট মাস নাগাদ বছর ৫৫-এর প্রতাপের মৃত্যু হয়। তারপরও তাজউদ্দিন মাঝেমধ্যেই যেতেন প্রতাপদের বাড়িতে। যদিও, ভোটার কার্ডের বিষয়টি আর কখনও উত্থাপিত হয়না।

সব পরিষ্কার হলো, ২০২৫ সালের নভেম্বরে এসআইআর আসার পর। সত্যচরণ বাবুর ছোট মেয়ে শিখা রাউতের বিয়ে হয়েছে মকরামপুর এলাকাতে। গত কয়েক বছর ধরে সেখানেই বাস করেন তাজউদ্দিন ওরফে বাবলু। এসআইআর-এর ফর্ম পূরণ শুরু হওয়ার পর কিছুটা সন্দেহের বশেই শিখা একদিন মকরামপুরের গোবিন্দপুর বুথের বিএলও কার্তিক পালের কাছে জানতে চান, তাজউদ্দিন ওরফে বাবলু এসআইআর-এর ফর্ম পূরণ করেছেন কিনা! কার্তিক বাবু জানান, তাজউদ্দিন বলে তিনি কাউকে চেনেন না, তবে ওই এলাকার বাবলু সিংহ ফর্ম পূরণ করেছেন। তাঁর বাবা সত্যচরণ সিংহ খড়পাড়া এলাকার বাসিন্দা! এরপরই মাথা ঘুরে যায় শিখার। বাপের বাড়িতে গিয়ে বাবা-মা, বৌদি (প্রতাপের স্ত্রী) এবং দাদার (প্রতাপের) ছেলেমেয়েদের বিষয়টি জানান। তারপরই গত ১১ নভেম্বর সবং থানায় মেইল মারফত অভিযোগ দায়ের করেন সত্যচরণ বাবু। অন্যদিকে, শিখা দেবী বিএলও কার্তিক পালকেও বিষয়টি জানান। কিন্তু, তারপর প্রায় দু-তিন সপ্তাহ কেটে গেলেও এই বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসন কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ায়, বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) তাঁরা সংবাদমাধ্যমকে বিষয়টি জানান। শিখা দেবী বলেন, ‘এসআইআর এলো বলেই, কিছুটা উৎসাহ ও সন্দেহের বশে আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখি। যা সন্দেহ করেছিলাম, তাই হয়েছে! এটা তো অন্যায়। আমি বিএলও-কে জানিয়েছি। আমার বাবার প্রায় ৮০ বছর বয়স। সবং ও নারায়ণগড় থানায় মেইল মারফত অভিযোগ দায়ের করেছেন।’ শিখা দেবী বলেন, ‘আমার দাদার ছেলেমেয়েরা আছে। এখন কোথা থেকে এসে এই বাবলু সিংহ যদি আমার বাবার সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে চায়, তখন কি হবে? তার থেকেও বড় কথা ওঁকে আমরা ভালোভাবে চিনিওনা। আমার দাদার সাথে পরিচয় হয়েছিল। আগে কেশিয়াড়িতে থাকতেন বলে শুনেছি এখন নারায়ণগড়ের মকরামপুরে থাকেন।’ সত্যচরণ বাবু বলেন, ‘কি বিপদে পড়লাম! বাবলু সিংহ বলে আমি কাউকে চিনিনা। দয়া করে প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।’ মকরামপুরের গোবিন্দপুর বুথের বিএলও কার্তিক সিংহ বলেন, ‘আমাকে শিখা দেবী বিষয়টি ফোন করে বলেন। কিন্তু, তার আগেই এই এলাকার বাবলু সিংহের ফর্ম পূরণ হয়ে যায়। বাবলু সিংহের ভোটার কার্ডে বাবা হিসেবে সত্যচরণ সিংহের নামই আছে। ২০০২-এর তালিকা অনুযায়ী, সত্যচরণ সিংহ সবংয়ের খড়পাড়া এলাকার বাসিন্দা। কিন্ত, উনি যে তাজউদ্দিন আমি জানব কি করে। উনি তো অনেকদিন ধরেই এই এলাকার ভোটার। বাবলু সিংহ নামেই পরিচিত। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যেমন নির্দেশ দেবে তেমন করব।’ জেলা পুলিশের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, ‘মেইল মারফত একটি অভিযোগ এসেছে। আমরা খতিয়ে দেখছি। কিন্তু, এই বিষয়ে নারায়ণগড়ের বিডিও-র কাছেও লিখিত অভিযোগ দায়ের করা উচিত।’ অন্যদিকে, সেখ তাজউদ্দিন ওরফে বাবলু সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি বাবলু সিংহ। এই এলাকার (মকরামপুরের) সবাই আমাকে চেনেন। তাজউদ্দিন বলে আমি কাউকে চিনিনা। আমাকে উনি (সত্যচরণ সিংহ) দত্তক নিয়েছিলেন। এখন নানা কারণে অস্বীকার করছেন!’