দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৪ নভেম্বর: চাকরির জন্য রাজ্য জুড়ে হাহাকার! প্রায় প্রতিদিন রাজপথে বেকার যুবক-যুবতীরা চাকরির জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন! দিচ্ছেন প্রতিশ্রুতিও। তবে, তাঁরও বোধহয় বুকের পাটা হয়নি, নবান্নের চৌদ্দ তলায় বসে চাকরির নিয়োগপত্র বিলানোর! হ্যাঁ, মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর রাজ্যে মেদিনীপুর মেডিক্যালে কলেজের এক ‘মহিলা কর্মী’ তাই করে দেখালেন। একের পর এক চাকরিপ্রার্থীকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের GOPD বিভাগের দোতলায় ডেকে ডেকে, এক্কেবারে হাতে হাতে “বানান ভুলে” ভরা নিয়োগপত্র তুলে দিচ্ছিলেন গত কয়েকবছর ধরে! তাতে অবশ্য মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সুপার (MSVP) এর ‘নকল’ (যদিও সবটাই বিচারাধীন) সই ও স্ট্যাম্পও ছিল। বিনিময়ে অবশ্য ‘কয়েক লক্ষ’ টাকা করে সেলামিও নিচ্ছিলেন ওই ‘মহীয়সী’ মহিলা! নিজে গ্রুপ- ডি কর্মী হয়েও চাকরি দিচ্ছিলেন গ্রুপ- সি পদমর্যাদার। বেতন অবশ্য আগেই বলে দিয়েছিলেন ১৫ হাজার টাকা! আর, এই পুরো প্রক্রিয়ায় সঙ্গী করেছিলেন মেদিনীপুর মেডিক্যালেই কর্মরতা নিজের মা-কে। মা-মেয়েতে মিলে প্রতারণাচক্রের বেশ ভালোই ‘ফাঁদ’ পেতেছিলেন! বেকারত্বের বাজারে একাধিক যুবক সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন অনায়াসেই। তাদের মধ্যেই জেলা শহর মেদিনীপুরের এক যুবক চাকরি করার দেড় বছর বাদে বুঝতে পারেন, ‘পুরোটাই ভুয়ো’, তাঁরা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। জলে পড়েছে সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা! দেড় বছরে বেতন পেয়েছেন সাকুল্যে এক-দেড় লক্ষ টাকা। মেদিনীপুর জেলা আদালতে করা সেখ আজাহারউদ্দিন নামক বছর ৩০ এর ওই যুবকের ‘প্রতারণা’ মামলার ভিত্তিতে শুক্রবার (১২ নভেম্বর) রাতে কোতোয়ালী থানার পুলিশ কৃষ্ণা রাউত নামক ওই ‘জালিয়াত’ মহিলা কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। শনিবার মেদিনীপুর জেলা আদালতে তাকে তোলা হলে, ১০ দিনের পুলিশ হেফাজত হয় তার।

thebengalpost.net
গ্রেফতার ওই মহিলা :

thebengalpost.net
সংগৃহীত ছবি :

জানা গেছে, মেদিনীপুর শহরের অলিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা, শিক্ষিত এম.এ পাস যুবক শেখ আজহারউদ্দিনের সঙ্গে ২০১৫ সাল নাগাদ পরিচয় হয় কৃষ্ণা রাউত (দাস) নামক ওই মহিলার। মহিলা নিজেকে এবং নিজের মা-কে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে কর্মরতা হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। পরে যুবক সেই বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পান। জানতে পারেন, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের GOPD বিভাগের দোতলায় কর্মরত বছর ৪০ এর ওই মহিলা ও তাঁর মা। থাকেন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালেরই স্টাফ কোয়ার্টারে। এরপরই, ওই মহিলা ও তাঁর মা প্রতারণার জাল বিছিয়ে যুবককে বলেন ৫ লক্ষ টাকা দিলে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে ও হাসপাতালে গ্রুপ-সি’ র স্থায়ী চাকরি পাইয়ে দেবে। বেতন প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা। আজহারউদ্দিন বেঙ্গল পোস্ট-ডিজিটাল মাধ্যমে বলেন, “আমি এবং আরও বেশ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব রাজি হই। পরে অবশ্য টাকার অঙ্ক শুনে বা বিভিন্ন কারণে তারা পিছিয়ে যায়। আমি ফাঁদে পড়ে যাই। দুই ধাপে ৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার পর, ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের GOPD বিভাগের দোতলায় ডেকে, আমার হাতে একটি টাইপ করা এবং বানান ভুল থাকা নিয়োগপত্র তুলে দেন ওই ভদ্রমহিলা। আমার সঙ্গে আরও এক যুবকের চাকরি হয় এবং একই নিয়োগপত্রে দু’জনের নাম থাকে। আমার সন্দেহ হওয়ায় নানা অজুহাত দেন। বলেন, ‘টাইপ মিসটেক হতে পারে, সুপারের সই তো আছে!’ এরপর, আমাদের ২ জনের নামমাত্র ট্রেনিং ও কাজ শুরু হয়ে যায়। প্রতি মাসে বেতনও হাতে হাতে দিতেন। কখনও ৫ হাজার, কখনও ৭ হাজার, কখনও ১০ হাজার। GOPD বিভাগের ক্যান্সার ক্লিনিকে (পিপি ইউনিটে) আমাদের পোস্টিং হয়। আসতে আসতে বিভিন্ন চিকিৎসক আমাদের চিনে যান। প্রতিদিন ওই ক্লিনিকে প্রসূতি মহিলাদের নমুনা পরীক্ষার কাজ করতাম। এই সময়ের মধ্যে আরও অন্তত ২০-৩০ জনকে একইভাবে নিয়োগপত্র দিয়েছেন। এইসব দেখে আমারও সন্দেহ ধীরে ধীরে কেটে যায়! এরপর, করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় কাজ বন্ধ থাকে, ফের ২০২০’র সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করি ২-৩ মাস। এই সময়ের মধ্যে অবশ্য গড়ে ৩-৪ হাজার টাকা করে ওই মহিলা দিয়ে দিতেন। ২০২১ দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় থেকে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে সেই যে বন্ধ হল কাজ, আর শুরু হয়নি, বেতনও বন্ধ। এরপর, আমি চাপ দেওয়ায় জুন মাসে (২০২১) উনি বলেন যে, ‘এটা তো চুক্তিভিত্তিক কাজ ছিল, বাদ দাও, তোমার যেহেতু এম.এ পাস করা আছে, আর দেড় লক্ষ টাকা দাও, তোমার প্রোমোশন ও স্থায়ী চাকরি হয়ে যাবে, ৩০ হাজার টাকা বেতনের।’ গত ২১ জুন আমি টাকা দিই, তবে স্ট্যাম্প প্যাপারে সবকিছু লিখিয়ে ও সই করিয়ে নিই। এরপর উনি আর চাকরি দিতে পারেননা, তখনই আমি আইনি পথে হাঁটি। কোতোয়ালী থানা অভিযোগ নিতে অস্বীকার করায়, অক্টোবর মাসে আইনজীবী সুদীপ দত্তের সহায়তায় মামলা করি। সম্প্রতি, কোর্ট নির্দেশ দেয়, ওনাকে গ্রেফতার করতে।” তারপরই, গত শুক্রবার (১২ নভেম্বর) রাতে, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের স্টাফ কোয়ার্টার থেকে কৃষ্ণা রাউত-কে গ্রেফতার করে পুলিশ। জানা গেছে, প্রতারিত অন্যান্য যুবকরাও ইতিমধ্যে আজহারউদ্দিনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছেন ওই মহিলা’র নামে FIR করবেন বলে! এদিকে গোটা ঘটনায় সম্পূর্ণ অন্ধকারে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মুখে কুলুপ এঁটেছেন সকলেই। বর্তমান সুপার ইন্দ্রনীল সেন জানিয়েছেন, “আইন আইনের পথে চলবে”। পুলিশ অবশ্য মনে করছে, এর পেছনে থাকতে পারে মেডিক্যাল কলেজেরই বড় কোনও চাঁই। জেলার জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ শ্যামপদ পাত্র জানিয়েছেন, “বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি। এই ধরনের ঘটনা একেবারেই কাম্য নয়। পুলিশ সঠিক তদন্ত করে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দিক।”

thebengalpost.net
এই পিপি ইউনিটেই চাকরি হয়েছিল শেখ আজহারউদ্দিনের :