দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৬ মে: মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও মাধ্যমিকে ৭৮ শতাংশ নম্বর। জঙ্গলমহল শালবনীর ভাদুতলা বিবেকানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী অনিন্দিতা হারতে হারতেও হেরে যায়নি! বরং জীবনের নতুন রূপকথা লেখার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে এখন থেকেই। অঙ্কে ৯০, পদার্থবিজ্ঞানে ৯০, বাংলায় ৮৩ নম্বর পেয়েছে অনিন্দিতা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ড. অমিতেশ চৌধুরী বলেন, “মাত্র চার-পাঁচ মাস পড়াশোনা করতে পেরেছে অনিন্দিতা। সেটাও নিজের জেদ আর একক প্রচেষ্টায়। ব্রেনের জটিল অস্ত্রপচারের পর চিকিৎসকদের নিষেধ ছিল, মাথায় উপর সামান্য চাপ দেওয়াও যাবেনা! কিভাবে দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিল, এখনও মনে করতে পারেনা ও। বরং মনে করার চেষ্টা করলেই মাথায় যন্ত্রণা অনুভব করে! আর তাই ওর এই ৭৮ শতাংশ নম্বর আমাদের কাছে ৯৫ শতাংশের নম্বরের চেয়ে কোন অংশে কম নয়! আমরা বিশ্বাস করি, এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা না ঘটলে অনিন্দিতা প্রায় ৯৪-৯৫ শতাংশ নম্বরই পেত।” তিনি জানান, মাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক এক বছর আগেই ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। রক্তাক্ত ও অচৈতন্য অবস্থায় বাড়ির অদূরেই রাস্তা থেকে উদ্ধার করা হয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনী ব্লকের ভাদুতলা বিবেকানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী অনিন্দিতা দাসকে। তারপর টানা ছ’মাস ধরে কার্যত যমে মানুষে টানাটানি! টানা ৪ দিন কোমায় ছিল অনিন্দিতা। ওড়িশার ভুবনেশ্বরের একটি হাসপাতালে সম্পন্ন হয় মস্তিষ্কের জটিল অস্ত্রপচার। এছাড়াও, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আঘাতেরও চিকিৎসা হয়। কার্যত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে জঙ্গলমহল শালবনীর ভাদুতলা সংলগ্ন প্রত্যন্ত ডাঙরপাড়া এলাকার বাসিন্দা অনিন্দিতা।

চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ব্রেনের উপর সামান্য চাপ দেওয়াও নিষেধ। রাতের পর রাত কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে ক্লাসে সর্বদা প্রথম অথবা দ্বিতীয় হওয়া অনিন্দিতা। মাধ্যমিকটা কি তবে এবার আর দেওয়া হবেনা? সব স্বপ্ন কি শেষ হয়ে যাবে এভাবেই? না, শেষপর্যন্ত অনিন্দিতা পেরেছে। পরীক্ষার মাত্র চার-পাঁচ মাস আগে থেকে একটু একটু করে পড়া শুরু করে বাড়িতে। অনিন্দিতার এই কঠিন লড়াইয়ে আন্তরিকভাবে পাশে থেকেছেন ভাদুতলা বিবেকানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ড. অমিতেশ চৌধুরী সহ অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। বোনকে সর্বদা সাহস জুগিয়েছেন অনিন্দিতার দুই দিদি অঙ্কিতা ও অনামিকাও। শেষপর্যন্ত মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসে অনিন্দিতা। ফল প্রকাশের পর দেখা যায় অঙ্কে ও পদার্থবিজ্ঞানে ৯০ (দু’টি বিষয়েই) নম্বর সহ মোট ৫৪৪ পেয়েছে অনিন্দিতা। প্রায় ৭৮ শতাংশ নম্বর। ভাদুতলা স্কুল থেকে সর্বোচ্চ ৬৫৯ (৯৪ শতাংশ নম্বর) নম্বর পেয়েছে ওম রায় নামে এক ছাত্র। অনিন্দিতাও সুস্থভাবে পরীক্ষা দিতে পারলে প্রায় কাছাকাছি নম্বরই পেত বলে জানান বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষিকা গৌরী মণ্ডল, ইংরেজির শিক্ষক সৌমেন সাহু কিংবা পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক অজয় কুমার ঘোষ প্রমুখ। অনিন্দিতার বাবা সুদীপ দাস চাষবাস করেই চার মেয়েকে মানুষ করছেন। বড় মেয়ে বি.টেক পাস করেছে। মেজ মেয়েও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। অনিন্দিতা ছোট থেকেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ছোট মেয়ে অন্বেষা ভাদুতলা স্কুলেই ক্লাস ফাইভে পড়ে। সুদীপ বাবু বলেন, “মাত্র ২-৩ বিঘা জমিতে চাষ করেই ওদের বড় করেছি, পড়াশোনা শিখিয়েছি। বড় মেয়ে সদ্য একটি বেসরকারি সংস্থাতে কাজ পেয়েছে বলে বোনেদের পড়াশোনার খরচ কিছুটা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারছে।”
কিভাবে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনিন্দিতা? সুদীপ বাবু জানান, “২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। খুব সকালে ও হেঁটে হেঁটে টিউশন পড়তে যাচ্ছিল। বাড়ি থেকে কয়েকশো মিটার দূরেই অচেনা কোন গাড়ি ওকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। অচৈতন্য অবস্থায় রাস্তায় পড়েছিল ও। খবর পেয়ে আমি ছুটে যাই। গিয়ে দেখি এক সিভিক পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন ওকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর তোড়জোড় করছে। প্রথমে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ, সেখান থেকে ভুবনেশ্বরে নিয়ে যাই। তিন-চার দিন ওর কোনও জ্ঞান ছিলোনা! তারপর একাধিক অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয় ধীরে ধীরে। তবে, পড়াশোনা সহ যেকোন ধরনের চাপ নেওয়ার বিষয়ে চিকিৎসকদের নিষেধ আছে এখনও। তাই হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে এলেও অনিন্দিতা স্কুলে কিংবা টিউশনে, কোথাও আর যেতে পারেনি। মাত্র চার-পাঁচ মাস বাড়িতে একা একাই পড়ে এই নম্বর পেয়েছে। সুদীপ বাবু তাই বলেন, “জানি ওর স্বপ্ন পূরণ করা খুব কঠিন। তবে মেয়ে বলছে, লড়াই ছাড়বেনা! সায়েন্সে ভর্তি হবে বলে মানসিক প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে। এখনও মাঝেমধ্যেই চেকআপে নিয়ে যেতে হয়। ডাক্তারবাবুদের পরামর্শ নিয়েই ওকে সায়েন্সে ভর্তি করব।” আর অনিন্দিতা বলে, “সবার আশীর্বাদে এত বড় লড়াই যখন লড়তে পেরেছি, বাকিটাও চেষ্টা করে দেখি!” অনিন্দিতার দুই দিদি বলে, “বোন যে ছোট থেকেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে…!”