দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৮ মে: মাত্র ৩ বছর বয়সে শরীরে বাসা বাঁধে বিরল স্নায়ুরোগ এসএমএ বা স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের আনন্দপুর থানার তাতারপুর গ্রামের কৃষক পরিবারে! কোটি কোটি টাকা জোগাড় করে মেয়ের চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য ছিল না পেশায় সামান্য কৃষক সর্বরঞ্জন বেরার। ওই বয়স থেকেই তাই মেধাবী স্বর্ণাভ-র এগিয়ে চলার সাথী হয় ‘হুইল চেয়ার’। খাওয়াদাওয়া, শোওয়াবসা সবকিছুর জন্যই বাবা-মা’র উপর নির্ভর করতে হয় স্বর্ণাভ-কে। আর পড়াশোনা? হ্যাঁ, সেটার জন্যও বাবা-মা’র উপরই নির্ভর করতে হয় তাকে। তবে, কোনও বাধাই অবশ্য শেষপর্যন্ত রুখে দিতে পারেনি পশ্চিম মেদিনীপুরের ‘গর্ব’ স্বর্ণাভ বেরা-কে। আনন্দপুর থানার সাহসপুর ঘোষাল হাইস্কুল থেকে ২০২৩ সালে ৬৫৭ নম্বর (৯৪ শতাংশ) পেয়ে মাধ্যমিক পাস করে স্বর্ণাভ। তখন থেকেই ‘ডাক্তার’ হওয়ার স্বপ্ন দেখে স্বর্ণাভ। উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা করে প্রায় ৯৫ শতাংশ নম্বর (৪৭৪) পেয়েছে সে। নিট পরীক্ষাও ভালো হয়েছে বলে বুধবার জানিয়েছে স্বর্ণাভ।

thebengalpost.net
বুধবারের সংবর্ধনা সভায় স্বর্ণাভ:

thebengalpost.net
বিজ্ঞাপন (Advertisement):

এদিন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের উদ্যোগে শহরের প্রদ্যোৎ স্মৃতি সদনে জেলার ৩৩ জন কৃতি ছাত্রছাত্রীকে সংবর্ধিত করা হয়। বাবার সেখানে হাজির হয়েছিল স্বর্ণাভও। স্বর্ণাভ-কে দেখে ও তার লড়াইয়ের কথা শুনে আবেগমথিত হয়ে পড়েন সকলেই। স্বর্ণাভ-কে সংবর্ধিত করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন রাজ্যের জলসম্পদ উন্নয়ন ও সেচ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী তথা পেশায় চিকিৎসক ডাঃ মানস রঞ্জন ভূঁইয়াও। ছলছল চোখে মন্ত্রী তার কাছে জানতে চান, ‘তুমি কি হতে চাও মা?’ দৃপ্ত কন্ঠে স্বর্ণাভ বলে, “আমি ডাক্তার হতে চাই। নিট পরীক্ষা ভালো হয়েছে। কিন্তু…!” মন্ত্রী তার মাথায় হাত দিয়ে বলেন, “কোন কিন্তু নয়, তুমি যতদূর পড়তে চাও, পড়া চালিয়ে যাও। আজ থেকে তোমার পড়াশোনার সব দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। পারিবারিক ভাবে আমরা একটি এনজিও চালাই। সেই এনজিও প্রতি বছর ২২ জন ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়। তোমার দায়িত্বও আমরা নিলাম!” স্বাভাবিকভাবেই এরপর আর চোখে জল ধরে রাখতে পারেননি কেউই। রাজ্যের ক্যাবিনেট মন্ত্রী এরপর স্বর্ণাভ-র বাবা (সর্বরঞ্জন বেরা)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ওর পড়া যেন না থামে! আমরা আপনার নাম-ঠিকানা সব নিয়ে নিচ্ছি। ওকে এগিয়ে যেতে দিন। ওর স্বপ্নপূরণের দায়িত্ব নিলাম আমরা।”

thebengalpost.net
মাথায় মন্ত্রীর হাত:

অপরদিকে, স্বর্ণাভ-র বাবা সর্বরঞ্জন বাবু জানান, “ওর লড়াই, জেদ আর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে আমরাও মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে যাই! মাধ্যমিকের পর উচ্চমাধ্যমিকেও ও স্কুলের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। আমরা খুবই খুশি। আমি সামান্য এক কৃষক। ওর মা (সোমা বেরা) গৃহবধূ। ছোট মেয়ে (সম্পূর্ণা) তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এতদিন কষ্ট করেই ওর (স্বর্ণাভ’র) লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছি এটা ঠিক, কিন্তু এরপর কিভাবে টেনে নিয়ে যাব, তা নিয়ে সত্যিই দুশ্চিন্তায় ছিলাম! মন্ত্রী মহাশয়ের ঘোষণায় আশ্বস্ত হলাম।” গত ২৪ মে (শনিবার) ‘না ফেরার দেশে’ পাড়ি দিয়েছে মেদিনীপুরের আরেক ‘গর্ব’ তথা মেধাবী ছাত্র ও উদীয়মান বাচিকশিল্পী অনুভব পাল। অনুভবও এই এসএমএ-তে আক্রান্ত ছিল। মাধ্যমিকে ৯০ শতাংশের বেশি (৬৩৩) নম্বর প্রাপ্ত অনুভবেরও বুধবার সংবর্ধিত হওয়ার কথা ছিল। অনুভবের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই, স্বর্ণাভ-র বাবা সর্বরঞ্জন বাবু বলেন, “হ্যাঁ, সবটাই জানি। কলকাতার ওই হাসপাতালেই ২০২৩ সালে স্বর্ণাভ-রও ওই একই অস্ত্রপচার হয়েছে। দু’টি জটিল অস্ত্রপচারের মাঝে প্রায় ২০ দিনের ব্যবধান ছিল। অনুভবের ক্ষেত্রে সেই ব্যবধানটা খুব কম হওয়ার জন্যই বোধহয়, ও নিতে পারলনা!”

thebengalpost.net
বাবার সাথে স্বর্ণাভ: