দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, কলকাতা, ১৩ মে: “নিয়োগের সময় অপ্রশিক্ষিত থাকা ৩৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল (Cancelled) করা হল বিভিন্ন কারণে (for various reasons)।” এমনই রায় ঘোষণা করেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। অপ্রশিক্ষিতদের (সেই সময় অপ্রশিক্ষিত, বর্তমানে যদিও সকলেই প্রশিক্ষিত) প্যানেল বা চাকরি বাতিলের কারণগুলিও তিনি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন নিজের রায়ের কপিতে (Judgement Copy)। প্রধান ২-৩টি কারণ হল- ১. ৫ নম্বরের অ্যাপটিটিউড টেস্ট (Aptitude Test) না নিয়েই নম্বর দেওয়া হয়েছে। বিশেষত, যাদের টেট ও অ্যাকাডেমিক নম্বর একেবারেই কম, তাদের ৫ এর মধ্যে ৪.৫ বা ৫ দেওয়া হয়েছে।
২. সংরক্ষণ নীতি বা Reservation Roster মানা হয়নি।
৩. সর্বোপরি, নিজেদের তৈরি ‘Recruitment Rules 2016’ নিজেরাই মানেনি মানিক ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন পর্ষদ।

নিজের রায়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাই লিখেছেন, “২০১৬ সালের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি সহ আধিকারিকদের কাজ অনেকটা স্থানীয় ক্লাবের মতো। আর ইডির তদন্তে উঠে এসেছে, যাঁদের টাকা ছিল প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি তাঁদের বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।” স্বাভাবিকভাবেই, গতকাল বিকেল থেকে এই ঐতিহাসিক রায় নিয়ে সারা রাজ্য শুধু নয়, দেশজুড়ে তোলপাড় পড়ে গিয়েছে। রাজ্য এবং দেশের প্রায় সমস্ত সংবাদমাধ্যমে এই বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

thebengalpost.net
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়ের কপি :

তবে, ৩৬ হাজার ‘অপ্রশিক্ষিত’ সংখ্যাটা নিয়ে একমাত্র বেঙ্গল পোস্ট ডিজিটাল মাধ্যম (The Bengal Post)-ই প্রথম থেকে সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছে। শুক্রবার রাতে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়ের কপি কলকাতা হাইকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত (Upload) হওয়ার পর, সেখানেও বিচারপতি ৩৬ হাজার (কমবেশি/more or less)-ই উল্লেখ করার পর আমরা (বেঙ্গল পোস্ট) আরও অবাক হই! কারণ, বিভিন্ন সময়ে কলকাতা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে পর্ষদের তরফে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, সংখ্যাটা হওয়া উচিৎ ছিল সর্বাধিক ৩২ হাজার। কোনোভাবেই তার বেশি নয়! কারণ, গত বৃহস্পতিবারও (১১ মে) সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু ও সুধাংশু ধুলিয়া’র ডিভিশন বেঞ্চে শুনানি চলাকালীন পর্ষদের সিনিয়র আইনজীবী জয়দীপ গুপ্ত এবং যোগ্য ও বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের সিনিয়র আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য যে পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিলেন, তা হল- প্রায় ১১ হাজার প্রশিক্ষিত (কিছু বেশি) এবং প্রায় ২৯ হাজার (কিছু বেশি) অপ্রশিক্ষিত নিয়োগ করা হয়েছে ২০১৬ সালের নিয়োগে। ৪২,৯৯৫ ভ্যাকান্সি বা শূন্য পদ ঘোষণা করেও, কেন মানিক ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন পর্ষদ ৪০ হাজার (বা, তার থেকে কিছু বেশি) শিক্ষক নিয়োগ করল, তা নিয়ে দুই বিচারপতি রীতিমতো চেপে ধরেছিলেন পর্ষদের আইনজীবীকে। মঙ্গলবার (১৬ মে) তিনি এর ব্যাখ্যা দেবেন বলেও জানিয়েছেন। অন্যদিকে, বিভিন্ন সময়ে কলকাতা হাইকোর্টের শুনানিতে উল্লিখিত হয়েছে, ১১ হাজারের বেশি প্রশিক্ষিত এবং ৩১ হাজারের সামান্য বেশি (৩১,৫০০ মতো) অপ্রশিক্ষিত নিয়োগ করা হয়েছে ২০১৬-‘১৭ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। তাই, প্রশিক্ষিতদের সংখ্যা কোনোভাবেই যে ১১ হাজারের কম নয়, তা ‘বেঙ্গল পোস্ট’ প্রথম থেকেই বলে এসেছে। আর, সেই হিসেবে মোট নিয়োগ ৪২,৫০০ ধরে নিলে (পর্ষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী), অপ্রশিক্ষিত (সেই সময় অপ্রশিক্ষিত বা d.el.ed সম্পূর্ণ না করা) শিক্ষকদের (শিক্ষক-শিক্ষিকা) সংখ্যা কোনোভাবেই ৩১ বা খুব বেশি হলে ৩২ হাজারের বেশি হতে পারেনা (যদিনা, এর ভেতরে আরো কোনো রহস্য লুকিয়ে থাকে)! এতদিন, কলকাতা হাইকোর্টের সমস্ত আইনজীবীরাও বিভিন্ন সময়ে এই সংখ্যাটাই (৩২ হাজার ও ১১ হাজার) উল্লেখ করেছেন। কিন্তু, শুক্রবার হঠাৎ করেই বিচারপতি ৩৬ হাজার ‘অপ্রশিক্ষিত’ উল্লেখ করার পর নতুন এক বিতর্কের সৃষ্টি হল নিঃসন্দেহে!

অবশেষে, ওই মামলার (প্রিয়াঙ্কা নস্কর মামলা) প্রধান আইনজীবী তরুণজ্যোতি তেওয়ারি-ও আজ অর্থাৎ শনিবার (১৩ মে) সকালে তাঁর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে (Tarunjyoti Tewari) স্বীকার করেছেন, “৩৬ হাজার চাকরি বাতিলের কথা হচ্ছে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি যে সংখ্যাটা একটু গোলমাল হয়েছে। প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং আরো দু-একটা ছোটখাটো ভুল আছে সেটাও Hon’ble Court -কে জানানো হবে।” সূত্রের খবর অনুযায়ী, আগামী সোমবার (১৫ মে)-ই এই ছোটখাটো ভুলের সংশোধন করে নেওয়া হবে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চে। এ প্রসঙ্গে এও উল্লেখ্য যে, আইনজীবী তরুণজ্যোতি তেওয়ারি আরও কিছু বিষয় স্পষ্ট করে জানিয়েছেন যে, “এই ৩৬ হাজারের মধ্যে (সংখ্যাটা আসলে ৩১-৩২ হাজারের কাছাকাছি) অনেকেই চাকরি ফিরে পাবেন। কিন্তু, একটা বড় অংশের চাকরি যাবে আজ নয় কাল।” এই বিষয়ে তাঁর অভিমত, “যাদের চাকরি বাতিল হল, তাদের মধ্যে…আমার হিসেবে ২৫ হাজার-কে নিয়ে অল্প সন্দেহ আছে এবং তার মধ্যে প্রায় ১২ হাজারের এর ঘাপলা (দুর্নীতি) খালি চোখে ধরা পড়ছে।” তবে, সেই সময় টেট (Primary TET 2014) পাস ১ লক্ষ ২৫ হাজার প্রার্থীই যে নতুন করে ইন্টারভিউ (অ্যাপটিটিউড টেস্ট সহ)’র জন্য আবেদন করতে পারবেন (ট্রেনিং সম্পূর্ণ না হলেও এবং বয়স ৪০ পেরিয়ে গেলেও) তাও স্পষ্ট করেছেন আইনজীবী তরুণজ্যোতি তেওয়ারি। সেকথা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়ের কপিতেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে।

thebengalpost.net
টেট ও অ্যাকাডেমিক (৫+১৫) এ ২০’র মধ্যে ৭.৫ কিংবা ৮; ইন্টারভিউ ও অ্যাপটিটিউড টেস্টে (১০ এর মধ্যে) ৯.৫ বা ১০ :