দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, মেদিনীপুর, ১৭ অক্টোবর: জেলা শহর মেদিনীপুরের ‘সবেধন নীলমণি’ সিনেমা হল ছিল হরি সিনেমা। আজ, শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) থেকে বন্ধ হয়ে গেল সেটিও। স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ মেদিনীপুরবাসীর। ভেঙে পড়েছেন হরি সিনেমার সঙ্গে যুক্ত স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মীরা। হতাশ সিনেমা হল সংলগ্ন দোকানদাররাও! শুক্রবার থেকে ‘হরি সিনেমা’ চিরতরে হারিয়ে যাবে শুনে সকলেই কার্যত হাহাকার করছেন।

thebengalpost.net
বন্ধ হলো হরি সিনেমা:

অন্যদিকে, কলকাতার বাসিন্দা তথা হরি সিনেমার বর্তমান মালিক (কর্ণধার) নাওল কিশোর থারাড বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বলেন, “১৯৯৪ সাল থেকে এই সিনেমা হল আমি লিজে নিয়ে চালাচ্ছি। স্বাভাবিকভাবেই, এই হল বন্ধ হয়ে যাবে, তা আমার কাছেও দুঃখের ও যন্ত্রণার। অতিমারীর সময় থেকে, প্রায় ৪-৫ বছর ধরে প্রবল ক্ষতি মাথায় নিয়েও চালিয়ে যাচ্ছিলাম। শেষপর্যন্ত আর টানতে পারলাম না!” তাঁর সংযোজন, “নতুন সিনেমা আনলেও বা হলে সিনেমা রিলিজ করালেও আর লোক হচ্ছেনা! দুর্গাপুজোর সময় থেকে এখনও পর্যন্ত মাত্র ৩০ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে। অথচ, দু’টি নতুন বাংলা সিনেমা (দেবী চৌধুরাণী ও রক্তবীজ) রিলিজ করিয়েছি এখানে।” অন্যদিকে, হরি সিনেমার কর্মীদের দাবি, “আমাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। তারপর উনি হল বন্ধ করুন।” বর্তমানে হরি সিনেমাতে ৩ জন স্থায়ী ও ৫ জন অস্থায়ী কর্মী। এছাড়াও কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। স্থায়ী কর্মীদের তরফে সমীরকুমার দাস বলেন, “বেশ কয়েক মাস ধরেই শুনছিলাম হল বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে তা বিশ্বাস করিনি। চলতি মাসের শুরুর দিকে হঠাৎই মালিক ফোন করে জানান, ১৭ অক্টোবর থেকে হল বন্ধ করে দেব। আমরা বলি, তাহলে আমাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।” তিনি বলেন, স্থায়ী কর্মীদের ৪ লক্ষ টাকা ও অস্থায়ী কর্মীদের ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে। তবে, এই বিষয়ে মালিক কোনও সদুত্তর দেননি বলেও অভিযোগ সমীর বাবুদের। সেক্ষেত্রে তাঁরা আন্দোলনের পথে যেতে বাধ্য হবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। হরি সিনেমা বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরে ভেঙে পড়েছেন হরি সিনেমা সংলগ্ন এলাকার ব্যবসায়ী বাণেশ্বর দাস, রাজেশ দাস, তারকনাথ আঢ্য প্রমুখও। তাঁরা বলেন, “একসঙ্গে অনেকগুলো পরিবার চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছে!” এই এলাকাতেও কার্যত ‘অন্ধকার’ নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

প্রসঙ্গত, একটা সময় অবধি মেদিনীপুর শহরে ছিল তিন-তিনটি জনপ্রিয় সিনেমা হল। ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আরোরা সিনেমা, ১৯৪৭ সালে (ফেব্রুয়ারি মাসে) প্রতিষ্ঠিত হয় হরি সিনেমা এবং ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মহুয়া সিনেমা। ২০০৮ সালে প্রায় পিঠোপিঠি সময়ে বন্ধ হয়ে যায় অরোরা সিনেমা ও মহুয়া সিনেমা। শোনা গিয়েছিল সেখানে গড়ে উঠবে মাল্টিপ্লেক্স। জমি জটিলতা সহ একাধিক কারণে অবশ্য তা আটকে গিয়েছে। গত ১৭ বছর ধরে তাই সিনেমাপ্রেমী শহরবাসীর হলে গিয়ে সময় কাটানোর বা বিনোদনের একমাত্র জায়গা ছিল হরি সিনেমা। যদিও, কোভিড কাল থেকেই ধুঁকতে শুরু করে ‘সবেধন নীলমণি’ সেই হরি সিনেমাও। ইন্টারনেট আর ওটিটি’র দাপটে তা আরও কোণঠাসা হয় পড়ে। সেইসঙ্গেই ৭৮ বছরের প্রাচীন এই সিনেমা হলের পরিকাঠামোগত উন্নতিও তেমন হয়নি। ফলে হলের প্রতি ক্রমশ আগ্রহ হারাতে থাকেন যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে বয়স্করাও। তা সত্ত্বেও শহরবাসী স্মৃতি আর আবেগের অনেকটা অংশ জুড়েই ছিল এই হরি সিনেমা। স্বাভাবিকভাবেই তা বন্ধের খবরে মনখারাপ মেদিনীপুর শহরবাসীর। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মেদিনীপুর শহরের সুপ্রতিষ্ঠিত কবি ও সিনেমা সমালোচক সিদ্ধার্থ সাঁতরা বলেন, “মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা হরিচরণ সাউ শহরের বল্লভপুরে প্রতিষ্ঠা করেন হরি সিনেমার। ১৯৪৭ সালে, ফেব্রুয়ারি মাসের চার তারিখ ‘কৃষ্ণলীলা’ ছবি দিয়ে শুরু হয় হরি সিনেমার পথ চলা। আমাদের কৈশোর আর যৌবনের অনেক স্মৃতিই জড়িয়ে আছে এই হরি সিনেমাকে ঘিরে। সেইসব দিনের কথা মনে করলে চোখে জল আসে বৈ কি!” শহরের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি তথা শর্ট ফিল্ম নির্মাতা ইন্দ্রনীল দে বলেন, “মনে পড়ে, মায়ের হাত ধরে প্রথম সিনেমা দেখতে এসেছিলাম এই হরি সিনেমা হলে। সিনেমাটি ছিল ফেলুদা সিরিজের ‘গোরস্থানে সাবধান’। পরে অনেক বাংলা, হিন্দি সিনেমা দেখেছি। সকলে মিলে সিনেমা দেখার সেই জায়গাটা শুক্রবার থেকে আর থাকবেনা, ভাবতেই পারছিনা!”

thebengalpost.net
কাজ হারিয়ে হতাশ কর্মীরা:

শহরের বল্লভপুরে হরি সিনেমা সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত মেদিনীপুর টাউন স্কুল (বয়েজ)-এর প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক তথা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. বিবেকানন্দ চক্রবর্তী বলেন, “মেদিনীপুর শহর থেকে একটা ঐতিহ্য চিরতরে হারিয়ে যাবে! এ বড় বেদনার। প্রশাসনের কাছে আবেদন জানাব, যেভাবেই হোক এই শহরে একটা সিনেমা হল গড়ে তোলা হোক।” শোনা যাচ্ছে, আগামী দু-এক বছরের মধ্যে মাল্টিপ্লেক্সের হাত ধরে ‘মহুয়া সিনেমা’ ফের খুলবে। তা সত্ত্বেও ‘স্মৃতি’ হারিয়ে হাহাকার করছেন শহরবাসী। এই বিষয়ে মেদিনীপুর শহরবাসীকে আশ্বস্ত করে অভিনেত্রী-সাংসদ জুন মালিয়া বলেন, “শুনে আমিও খুব হতাশ হলাম! তবে, অনেক আগে থেকেই আমি মেদিনীপুর শহরে একটি ভালো সিনেমা হল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। এই বিষয়ে সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কথাও হয়েছে।” সাংসদ এও বলেন, “মহুয়া সিনেমাকে বাদ দিয়েও যাতে আরও একটি হল চালু করা যায়, আমি সেই চেষ্টা অবশ্যই করব।”

thebengalpost.net
হতাশ দোকানদাররাও: