দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৪ অক্টোবর: দলীয় রাজনীতিতে দীপক সরকারের অনুগামী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন সুশান্ত ঘোষ। তাঁদের ‘গুরু-শিষ্য’ সম্পর্ক পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিআইএম-এর অন্দরমহলে সর্বজনবিদিত। সেই ‘গুরু’ দীপক সরকারের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ ‘শিষ্য’ সুশান্ত ঘোষ শেষযাত্রায় থাকলেন একেবারে সামনের সারিতেই। একটি অভিযোগের ভিত্তিতে, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে সুশান্ত ঘোষকে জেলা সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল সিপিআইএম। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জেলা সম্মেলনে উপস্থিত থাকলেও, জেলা কমিটি থেকে বাদ পড়েন সুশান্ত। ফেব্রুয়ারিতে বাদ পড়েন রাজ্য কমিটি থেকেও। সবমিলিয়ে দল তাঁকে এই মুহূর্তে ‘অচ্ছুত’ করে রাখলেও, গুরুর অন্তিমযাত্রায় একেবারে সামনের সারিতেই হাঁটলেন গড়বেতা তথা জঙ্গলমহলের একসময়ের দাপুটে নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, অসুস্থ ও অশক্ত শরীরেও ‘নিষ্ঠাবান সৈনিক’ হিসেবে নিয়মিত মেদিনীপুর শহরের মীরবাজার স্থিত জেলা কার্যালয়ে আসতেন দীপক সরকার। সোমবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিকেল ৫-টা থেকে সন্ধ্যা ৬-টা পর্যন্ত ছিলেন জেলা কার্যালয়ে। বিধাননগরের বাড়িতে ফিরেও সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মেই করেছেন। এমনকি রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফোনে এক কর্মীর সাথে কথাও বলেছেন তিনি। হঠাৎই রাত্রি ১১টা নাগাদ অসুস্থতা অনুভব করেন তিনি। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সিপিআইএম-এর প্রাক্তন জেলা সম্পাদক তথা প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য দীপক সরকার। মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত জেলা পার্টি অফিসে তাঁর দেহ রাখা হয় শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। জেলা ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অগণিত কর্মী-সমর্থক ও অনুগামীরা পৌঁছন ফুল ও মালা নিয়ে। এসেছিলেন বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা, স্কুল ও কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মীরা। অখন্ড মেদিনীপুরের প্রবীণ বাম নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন সিপিআইএম-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা দীপকবাবুরই সমসাময়িক মেদিনীপুরের বর্ষীয়ান নেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও।
সেলিম বলেন, “দীপক দা আমাদের পার্টির অখন্ড মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক (১৯৯২-২০০২) ছিলেন। জেলা ভাগ হওয়ার পর পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক (২০০২-২০১৫) ছিলেন। রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীরও দীর্ঘদিনের সদস্য (২০১০-২০২২) ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে, সংগঠক হিসেবে, সমাজকর্মী হিসেবে তাঁর নিজস্ব একটা ভূমিকা ও অবদান ছিল। কঠিন সময়ে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।” একটা সময় পর্যন্ত দলীয় রাজনীতিতে দীপকের ভিন্ন মেরুতে অবস্থানকারী সূর্যকান্ত বলেন, “পার্টির সংগঠন, সংগ্রাম, মতাদর্শ ও রাজনীতি, যে চারটাকে আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি, সেই বিষয়গুলি তিনি আজীবন, এমনকি মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত দায়িত্বের সাথে পালন করে গেছেন।” মঙ্গলবার বেলা আড়াইটা নাগাদ অর্ধনমিত পতাকা হাতে এবং সুসজ্জিত মিছিল সহকারে দলের জেলা কার্যালয় থেকে প্রয়াত দীপক সরকারের দেহ নিয়ে কর্মী-সমর্থকেরা রওনা দেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের উদ্দেশ্যে। তাঁর শেষ ইচ্ছে ও অঙ্গীকারকে সম্মান জানিয়ে বিকেল ৩টা নাগাদ মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে ‘দেহ’ তুলে দেওয়া হয়। তার আগে শেষ শ্রদ্ধা জানান, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ মৌসুমী নন্দী, সুপার ইন্দ্রনীল সেন প্রমুখ। উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে এই মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন অধ্যাপক দীপক সরকার। শেষযাত্রা থেকে দেহদান- এই পুরো সময়ে দলীয় নেতৃত্ব ও কর্মী-সমর্থকদের শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা ছিল চোখে পড়ার মতো!