দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৩ ফেব্রুয়ারি: ছোট ছেলের কাছেই থাকতেন বৃদ্ধা মা। মা-কে দাদাদের কাছে রেখে স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা থানার নলপা গ্রামের বাসিন্দা প্রণব সাহা। মহাকুম্ভে পৌঁছনোর আগেই, শনিবার রাত্রি দেড়টা নাগাদ ঝাড়খণ্ডের ধানবাদে (রাজগঞ্জ থানা এলাকায়) মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় প্রণব (৪২), তাঁর স্ত্রী শ্যামলী (৩৪) ও শিশুকন্যা অন্বেষা (৬)-র। ধানবাদের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে তাঁদের নাবালক ছেলে সুদীপ (১৩)। শনিবার সকাল ১০টা নাগাদ খবর এসে পৌঁছয় গড়বেতা থানার নলপাতে। শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো গ্রাম! ছোট ছেলে, বৌমা, নাতনির এই মৃত্যু সংবাদ বৃদ্ধা সইবেন কি করে? এই ভেবে এখনও তাঁকে শোনানো হয়নি দুঃসংবাদ! গ্রাম থেকে একটি গাড়িতে করে বেশ কয়েকজন রওনা দিয়েছেন মৃতদেহ নিয়ে আসার জন্য। গিয়েছেন গড়বেতা থানার এক পুলিশ আধিকারিকও। সমস্ত ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের তরফে।

প্রসঙ্গত, নলপা গ্রামের বাসিন্দা প্রণব সাহা ওই পরিবারের ছোট ছেলে। তাঁর তিন দাদা আছেন। বাবা সাধন সাহা আগেই মারা গিয়েছেন। মা সুমিত্রা সাহা তাঁর কাছেই থাকেন। প্রণবের দু’টি গাড়ির গ্যারেজ আছে বলে। তাঁর তিন দাদার মধ্যে দুই দাদাও ওই ব্যবসার সথেই যুক্ত। শুক্রবার প্রণব তাঁর স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে প্রথমে গিয়েছিলেন হুগলির গোঘাটে। সেখান থেকে প্রণবের শ্যালিকা (পিয়ালী সাহা)-র পরিবারও তাঁদের সঙ্গে রওনা দেন। একটি স্করপিও এবং একটি টাটা নেক্সন গাড়িতে করে মোট ১৮ জন রওনা দিয়েছিলেন। স্করপিওতে ছিলেন প্রণব সাহা (৪২), তাঁর স্ত্রী শ্যামলী সাহা (৩৪), দুই সন্তান সুদীপ (১৩) ও অন্বেষা (৬) এবং বিশ্বরূপ সাহা (৪০), তাঁর স্ত্রী পিয়ালী সাহা (৩০) এবং তাঁদের দুই সন্তান যথাক্রমে সায়ন (১২) ও আগমনী (৬) সহ মোট ১১ জন (গাড়ির চালক সেখ রাজন আলি সহ)। নেক্সনে ছিলেন চালক সহ ৭ জন। রাত্রি দেড়টা নাগাদ ধানবাদের রাজগঞ্জ থানা এলাকায় জাতীয় সড়কের উপর প্রণবদের স্করপিও গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের পেছনে ধাক্কা মারে। এর ফলে পেছনে থাকা নেক্সন গাড়িটিও সজোরে এসে ধাক্কা মারে স্করপিওর পেছনে! দুমড়ে মুচড়ে যায় স্করপিও গাড়িটি। গাড়ির ভেতরে থাকা যাত্রীদের বহু কষ্টে পুলিশ উদ্ধার করে, দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে প্রণব, শ্যামলী, পিয়লী এবং স্করপিওর চালক সেখ রাজন (গোঘাটের বাসিন্দা)-কে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। বিকেল ৩টা নাগাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় শ্যামলী ও পিয়ালীর দুই শিশুকন্যা যথাক্রমে অন্বেষা ও আগমনীরও। ধানবাদের একটি বেসরকারি হাসপাতালের ভেন্টিলেশনে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে প্রণব-শ্যামলীর নাবালক সন্তান সুদীপ এবং পিয়ালীর স্বামী বিশ্বরূপ! তবে, বিশ্বরূপ-পিয়ালীর নাবালক সন্তান সায়ন তুলনামূলকভাবে ভাল আছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও, চিকিৎসাধীন আরও এক বছর ৫০-র মহিলার শারীরিক অবস্থাও স্থিতিশীল। ১৮ জনের ওই দলের বাকিরা সকলেই ভালো আছেন বলে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। মেদিনীপুরের বিধায়ক সুজয় হাজরা, গড়বেতা-১ নং পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি সেবব্রত ঘোষরা পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার জানিয়েছেন, “অত্যন্ত দুঃখজনক খবর! আমরা ধানবাদ পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। মোট ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে এক শিশু সহ পশ্চিম মেদিনীপুরের ৩ জন। হুগলির ৩ জন।” গড়বেতা-১নং পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি সেবাব্রত ঘোষ বলেন, “মোটামুটি ভাবে সমৃদ্ধশালী পরিবার বলেই আমরা জানি। পুণ্য অর্জনের পথে পাড়ি দিয়ে একটা পুরো পরিবার প্রায় শেষ হয়ে গেল! বৃদ্ধা মা সহ্য করতে পারবেন না ভেবে, আমরা এখনও কিছু জানাইনি তাঁকে। তবে, জানাতে তো হবেই! ভোররাতের দিকে মৃতদেহ পৌঁছে যেতে পারে। আমরা পরিবারের পাশে আছি।” শনিবার রাত্রি ৯টা নাগাদ ধানবাদ থেকে ফোনে রঘু নায়েক সিংহ (গড়বেতা থেকে গিয়েছেন) জানান, “ধানবাদের একটি সরকারি হাসপাতালে ৬ জনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়ছে। আমরা সবেমাত্র ৪টি শববাহী শকটে ৬ জনের দেহ নিয়ে রওনা দিলাম। দুটি শববাহী শকটে দুই (শ্যামলী ও পিয়ালীর) মায়ের সাথে তাঁদের কন্যাদের (অন্বেষা ও আগমনীর) দেহ রাখা হয়েছে! দু’টি শববাহী শকট হুগলি যাবে। আর আমরা সরাসরি যাব গড়বেতার নলপাতে।”