মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৪ অক্টোবর: বরফ কি তবে গলছে? নাকি পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে সমর্থকদের সামনে জেলা তৃণমূলের ঐক্যবদ্ধ চেহারা তুলে ধরার প্রয়াস? নাকি নিছকই বিজয়ার সৌজন্য? শালবনী ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের উদ্যোগে পিড়াকাটায় অনুষ্ঠিত বিজয়া সম্মিলনীর মঞ্চে জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা, বিধায়ক জুন মালিয়া ও মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাত-কে পাশাপাশি বসতে দেখে আপাতত এই প্রশ্নগুলোই উঠছে জেলা রাজনীতির অন্দর মহলে। কানাঘুষো, চোখ চাওয়াচাওয়ি খোদ শাসকদলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও! তবে, উচ্ছ্বসিত দলের বেশিরভাগ কর্মী-সমর্থকরা। খুশি শালবনী ব্লক তৃণমূল নেতৃত্বও। বৃহস্পতিবার পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গল অধ্যুষিত পিড়াকাটার কমিউনিটি হলে অনুষ্ঠিত হল ব্লক তৃণমূলের জমজমাট বিজয়া সম্মিলনী। সেখানেই এই মিলন-মধুর চিত্র দেখা যায়। মাঝখানে মেদিনীপুরের বিধায়ক তথা রাজ্য সম্পাদক জুন মালিয়া, তাঁর একপাশে জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা এবং অন্য পাশে শালবনীর বিধায়ক তথা রাজ্যের ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাত। ছিলেন INTTUC’র রাজ্য সভাপতি ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য সম্পাদক প্রদ্যোৎ ঘোষ, জেলা যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি সন্দীপ সিংহ, জেলা INTTUC সভাপতি গোপাল খাটুয়া, জেলা কিষাণ ক্ষেত মজদুর তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি শ্যামসুন্দর সৎপথী, জেলা মহিলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী মামণি মাণ্ডি এবং শালবনী ব্লক তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি নেপাল সিংহ সহ অন্যান্য জেলা ও ব্লক নেতৃবৃন্দ।
সবমিলিয়ে, জঙ্গলমহল পিড়াকাটার মঞ্চে জেলা তৃণমূলের ঐক্যবদ্ধ এই বিজয়া সম্মিলনী ঘিরে কর্মী সমর্থকদের উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল চোখে পড়ার মতো! শালবনীর পর মেদিনীপুর সদর ব্লকেও ছিলো উৎসবের মেজাজ, মিলনের আবহ! হাসিমুখে দেখা গেল জুন-সুজয়কে। সদর ব্লকের অনুষ্ঠানে অবশ্য উপস্থিত ছিলেন না মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাত। তবে, ছিলেন ঋতব্রত, প্রদ্যোৎ, সন্দীপ’রা। এদিন, বিকেলে প্রথমে পিড়াকাটাতে অনুষ্ঠিত শালবনী ব্লক তৃণমূলের বিজয়া সম্মিলনীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও দিলেন নেতৃত্বরা। বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্ত, সিপিআইএম- এর অপপ্রচার’কে উপেক্ষা করে ফের জঙ্গলমহলে সবুজ ঝড় তোলার আহ্বান জানান INTTUC রাজ্য সভাপতি ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চ থেকে বিধায়ক জুন মালিয়া বলেন, “মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পঞ্চায়েতে লড়াই করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিরোধীদের মোকাবিলা করতে হবে।” তবে, সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় ‘দূরত্ব’ মিটিয়ে, সমস্ত ‘তিক্ততা’ ভুলে জুন, সুজয় আর শ্রীকান্ত’র ‘কাছাকাছি’ আসার ঘটনা! কারণ, তাঁদের মধ্যে সাম্প্রতিক ‘অম্লমধুর’ সম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত। এমনকি, জানেন স্বয়ং দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-ও। সম্প্রতি, জুন সহ তৃণমূলের ‘সেলিব্রেটি’ জনপ্রতিনিধি ও পদাধিকারীদের প্রতি শ্রীকান্তের ‘বিতর্কিত মন্তব্য (‘সব লুটেপুটে খাচ্ছে….’) ইস্যুতে হস্তক্ষেপও করতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীকে। জুনকে ফোন করে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশও দিয়েছিলেন তিনি!
অন্যদিকে, জেলা শহর কেন্দ্রিক রাজনীতির নানা ইস্যুতে সুজয়-বিশ্বনাথ (মেদিনীপুর শহর সভাপতি বিশ্বনাথ পাণ্ডব) এর সঙ্গেও বছরখানেক ধরে বনিবনা হচ্ছিল না জুনের। অবশেষে, সুজয়-জুন’কে দীর্ঘদিন পর একসাথে হাসিমুখে দেখা গেল! তবে কি, জঙ্গলমহলের বিজয়া সম্মিলনী থেকেই ‘অম্লমধুর’ সম্পর্ক ‘মিষ্টিমধুর’ এ পরিণত হল? নাকি, এর পেছনেও আছে বৃহত্তর কোনো রাজনৈতিক সমীকরণ? অথবা, শীর্ষ নেতৃত্বের চাপ? জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা এদিন অবশ্য এসব জল্পনা উড়িয়ে দিয়ে জানিয়েছেন, “এরকম কোনো বিষয়ই নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ দল। হ্যাঁ, একই পরিবারে যেমন কখনও কখনও মতের অমিল, মান-অভিমান হয়; তেমনই হয়তো কখনও কখনও হয়েছে। কিন্তু, দলীয় নির্দেশ, শৃঙ্খলা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তা কখনোই প্রভাব ফেলেনি। ওঁরাও মন্ত্রী, বিধায়ক হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন এবং করছেন। আমরাও ঐকান্তিক ভাবে সংগঠনের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি। বিজয়ার এই সুন্দর অনুষ্ঠান থেকে কর্মীদের উদ্দেশ্যে একটাই বার্তা দিতে চেয়েছি আমরা- সমস্ত বিরোধিতা, চক্রান্ত হেলায় উড়িয়ে দিয়ে আকাশে ফের সবুজ আবির ওড়াতে হবে! পঞ্চায়েত হোক বা লোকসভা, আবারো জননেত্রীর জয়ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করতে হবে।” এদিকে, ব্লক তৃণমূলের বিজয়া সম্মিলনী এমন মিলন-মঞ্চ হয়ে ওঠায়, অন্যতম উদ্যোক্তা তথা অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সন্দীপ সিংহ বললেন, “বিজয়ার এমন মঞ্চই তো দেখতে চেয়েছিলেন শালবনী সহ আপামর জেলাবাসী!”