দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২ ডিসেম্বর: তাঁর মৃত্যুর (১৮১২) ১৬ বছর পর জন্মগ্রহণ (১৮২৮) করেছিলেন ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ। তবুও, ঝাঁসির রানী’র তুলনায় ইতিহাসে অনেকাংশেই উপেক্ষিত কর্ণগড়ের রানী শিরোমণি। ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’ (বা কৃষক বিদ্রোহ)- এর দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৭৯৮-‘৯৯) মেদিনীপুর, শালবনী, গড়বেতা, আনন্দপুরের কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী রানী শিরোমণি। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ‘বীরাঙ্গনা’ শিরোমণি’র এই লড়াইয়ের ইতিহাস বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আজও উপেক্ষিত! উপেক্ষিত তাঁর দুর্গ বা গড় (রানী শিরোমণি’র গড়)-ও। দীর্ঘ কয়েক বছরের লড়াইয়ের পর, পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গল অধ্যুষিত শালবনীর কর্ণগড় স্থিত এই শিরোমণি’র গড়কে সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্তরিক উদ্যোগে ‘হেরিটেজ’ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাঁর-ই নির্দেশে ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে ব্লক ও জেলা প্রশাসন। তবে, কোন এক অজানা কারণে গত কয়েক মাস ধরে উন্নয়নের কাজ একদিকে যেমন থমকে গেছে, ঠিক তেমনই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী চাইলেও পুরো গড়কে ‘হেরিটেজ জোন’ হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে, শুধুমাত্র দু’টি স্থাপত্যকে ‘স্টেট প্রটেক্টেড মনুমেন্ট’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে বলেই অভিযোগ স্থানীয় সমাজকর্মী বৃন্দ থেকে শুরু করে এলাকাবাসীর। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ঘটে গেল আরও এক বিতর্কিত কান্ড! রানী শিরোমণি’র গড়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় নির্মিত সরকারি কটেজ থেকে বিভিন্ন আসবাবপত্র গড়বেতার গনগনিতে সদ্য গড়ে ওঠা কটেজে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলো জেলা প্রশাসনের তরফে। আর, এই উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা ঘিরেই গভীর রাতে উত্তেজনা তৈরি হয় কর্ণগড় সংলগ্ন রানী শিরোমণি’র গড়ে।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বা মধ্যরাতে (রাত্রি সাড়ে এগারোটা-বারোটা নাগাদ) শালবনীর ব্লকের কর্নগড় সংলগ্ন রানী শিরোমণি’র গড়ে ঘটনাটি ঘটে। এলাকাবাসীদের অভিযোগ, বৃহস্পতিবার রাত্রি সাড়ে ১১টা-১২ টা নাগাদ গড়বেতা বিডিও অফিসের কয়েকটি গাড়ি কর্ণগড়ের শিরোমণির গড় পর্যটন কেন্দ্রে আসে। মধ্যরাতে গাড়ি দেখে সন্দেহ হওয়ায় গ্রামবাসীরা জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, গড়বেতা ১ নং ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির কর্মীদের কর্ণগড়ের কটেজগুলিতে থাকা সমস্ত আসবাবপত্র গড়বেতার গনগনি পর্যটন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে, লিখিত নয়, পুরোটাই মৌখিক নির্দেশ! এরপর, গ্রামবাসীরা ওই সরকারি কর্মীদের কাছে সরকারি অর্ডার বা নির্দেশিকা দেখতে চান। তবে, তাঁদের কাছে সেসব কিছুই ছিলো না! এরপরই, গ্রামবাসীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং কর্ণগড় থেকে আসবাবপত্র নিয়ে যাওয়ার কাজে বাধা দেন। ফলে খালি হাতেই ফিরতে হয় গড়বেতা পঞ্চায়েত সমিতি ও ব্লক কার্যালয়ের কর্মীদের। শুক্রবার সকালে এই বিষয়ে গড়বেতা ১ নং ব্লকের বিডিও ওয়াসিম রেজা জানিয়েছেন, “জেলা প্রশাসনের তরফে আমার কাছে নির্দেশ আসে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ। তারপরই আমরা কয়েকটি গাড়ির ব্যবস্থা করে কর্মীদের পাঠাই।” তবে, কর্মীদের হাতে লিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়নি বলে তিনি স্বীকার করে নেন। অন্যদিকে, শালবনীর বিডিও প্রণয় দাস-ও একই কথা জানান।
অপরদিকে, জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গনগনি পর্যটন কেন্দ্র অবিলম্বে চালু করার নির্দেশ এসেছে। এই মুহূর্তে যেহেতু রানী শিরোমণি’র গড়ে সংস্কারের কাজ চলছে, তাই কিছু আসবাবপত্র সাময়িকভাবে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে, শুধু কর্ণগড় এলাকাবাসী নন, শালবনী পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও কর্মাধ্যক্ষরাও বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, কোন এক অজানা কারণে শিরোমণি’র স্মৃতিধন্য ঐতিহাসিক গড়ে সংস্কারের কাজ বা উন্নয়নের কাজ খুব শ্লথ গতিতে চলছে। এরপর আবার এক পর্যটন কেন্দ্র থেকে অন্য পর্যটন কেন্দ্রে আসবাবপত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! এলাকাবাসীদের ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সন্দীপ সিংহের মতে, “এই গড়কে কেন্দ্র করে শালবনী তথা জেলাবাসীর মধ্যে একটি বিশেষ আবেগ আছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্তরিক উদ্যোগে এই গড়কে ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র রূপে গড়ে তোলার কাজ শুরু হওয়ায়, এলাকাবাসী অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। উৎসাহী পর্যটকরাও আসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু, অত্যন্ত শ্লথ গতিতে সংস্কারের কাজ চলায়, অনেকেই ক্ষুব্ধ। তার উপর এখানকার কটেজের আসবাবপত্র সরানোর বিষয়টি এলাকাবাসী ভালো ভাবে নেননি। আমাদের দাবি, উভয় পর্যটন কেন্দ্রকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা হোক। আমরা অবিলম্বে বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।”