দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১ অক্টোবর: “গত বছর পুজোর সময় আমরা মেদিনীপুর শহরে ছিলাম। মেয়েটার তখন সবে ১ বছর বয়স। ওকে নিয়েই ঘুরেছি। সব ঠাকুর দেখেছিলাম…!” বলতে বলতেই গলাটা ধরে আসে সন্ধ্যার। গত ১৫ আগস্ট সকালে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তাঁর স্বামী তথা পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরার বৌলাসিনি হাইস্কুলের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের ‘যোগ্য’ (আনটেন্টেড) শিক্ষক সুবল সোরেনের। তারপর থেকেই পরিবারে নেমে আসে ‘অন্ধকার’! স্বাভাবিকভাবেই এবার আর পুজোর আলো নেই সন্ধ্যার পরিবারে।

thebengalpost.net
সুবল সোরেন (ছবি- সংগৃহীত):

thebengalpost.net
বিজ্ঞাপন (Advertisement):

মঙ্গলবার, অষ্টমীর দিন বিকেলে কান্না ভেজা গলায় সন্ধ্যা বলেন, “এবার আর বাড়ি থেকে বেরোইনি। শরীর, মন কিছুই ভালো নেই। বাড়ির কারুরই মন ভালো নেই!” ‘মন’ ভালো থাকার অবশ্য কথাও নয়। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে ছিলেন সন্ধ্যার স্বামী সুবল। অনেক ‘লড়াই’ করে শিক্ষকতার চাকরিটা পেয়েছিলেন তিনি। ২০১৬-র SSC-তে নিজের ক্যাটাগরিতে সুবলের র‌্যাঙ্ক ছিল ‘চার’। গত ৩ এপ্রিল (২০২৫) সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সেই চাকরিটাই চলে যায় সুবলের। তারপর থেকেই দুশ্চিন্তায় ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের এই ‘যোগ্য’ (আনটেন্টেড) শিক্ষক। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা ছাড়াও স্ত্রী ও দু’বছরের শিশুকন্যা! প্রবল দুশ্চিন্তা আর হতাশা সত্ত্বেও, কলকাতা থেকে মেদিনীপুর, চাকরিহারাদের আন্দোলনে সর্বত্র তাঁকে প্রথম সারিতে দেখা গিয়েছে। শেষমেশ আর পেরে ওঠেননি সুবল! গত ১১ আগস্ট (২০২৫) ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন তিনি। ডেবরা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল থেকে তাঁকে রেফার করা হয় কলকাতায়। সেখানেই (কলকাতায়) একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ আগস্ট সকাল ৮টা নাগাদ না ফেরার দেশে পাড়ি দেন ‘যোগ্য-শিক্ষক’ সুবল সোরেন। সুবলের সহযোদ্ধা তথা পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্য যোগ্য শিক্ষকরা বলেন, মেধাবী সুবল হয়তো আদালতের নির্দেশে অনুষ্ঠিত গত ৭ ও ১৪ সেপ্টেম্বরের পরীক্ষাতে পাস করে আবারও নিজের চাকরিটা ফিরে পেতেন; কিন্তু সবার পক্ষে তো সেই চাপটা নেওয়া সম্ভব নয়! কৃষ্ণগোপাল চক্রবর্তীর, সুদীপ মুখার্জিরা বলেন, “এই দায় নিতে হবে রাজ্য সরকার এবং আদালতকেই। সরকার দুর্নীতি করল, আর আদালত যোগ্যদের চাকরিটা কেড়ে নিল! মাত্র ৩৫ বছরের তরতাজা শিক্ষক চলে গেলেন। ওঁর পরিবারের কি হবে! সুবলের দু’বছরের কন্যা সন্তানের কি হবে? আমরা আমাদের চাকরি ফিরে পাওয়ার সাথে সাথেই সুবলের স্ত্রী-র জন্য উপযুক্ত চাকরির দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি এবং চালিয়ে যাব।”

thebengalpost.net
সন্ধ্যা সোরেন:

সুবলের বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের মোহনপুর ব্লকের রেমু সংলগ্ন সরকি গ্রামে। মেদিনীপুরের একটি মেসে থেকে পড়াশোনা করতেন তিনি। সেই সূত্রেই চাকরি পাওয়ার পর মেদনীপুরে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। তবে, দূরত্ব বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে বছরখানেক আগে ডেবরা বাজারের কাছে (স্কুলের কাছাকাছি এলাকায়) বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে আসেন তিনি। সেই বাড়িতেই এখনও সুবলের সমস্ত জিনিসপত্র আছে। এই মাসের ভাড়া মিটিয়ে আজ, বুধবারই (১ অক্টোবর) সেই বাড়িটা ছেড়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন সুবলের ভাইরা ভাই (শ্যালিকার স্বামী) তথা সন্ধ্যার জামাইবাবু মাধবচন্দ্র হাঁসদা। বর্তমানে তাঁরা সকলেই দাঁতনের আনিকোলা গ্রামে, সুবলের শ্বশুরবাড়িতে আছেন। ষষ্ঠীর দিন (রবিবার) বিকেলে সেখানে গিয়েই পশ্চিম মেদিনীপুরের তিন যোগ্য শিক্ষক কৃষ্ণগোপাল চক্রবর্তী, সুদীপ মুখার্জি ও সত্য সোরেন সুবলের স্ত্রী সন্ধ্যার হাতে পুজোর নতুন বস্ত্র কেনার জন্য কিছু অর্থ তুলে দিয়েছেন। ভবিষ্যতেও তাঁরা সন্ধ্যা ও তাঁর শিশুকন্যা সুপ্রিয়া-র ভবিষ্যৎ ‘সুরক্ষিত’ করার জন্য পাশে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। সন্ধ্যার জামাইবাবু বলেন, “প্রশাসনের কাছে আমাদের একটাই আবেদন, সুবল যোগ্য শিক্ষক ছিল। অনেক লড়াই করে এই চাকরিটা পেয়েছিল সে। ওঁর স্ত্রী ও শিশুকন্যার কথা ভেবে সন্ধ্যার শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত চাকরির ব্যবস্থা করা হোক।” সন্ধ্যা (সুবলের স্ত্রী) উচ্চ মাধ্যমিক পাস বলেও জানিয়েছেন তিনি। পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন দাঁতনের বিধায়ক বিক্রমচন্দ্র প্রধান।

thebengalpost.net
সন্ধ্যার সঙ্গে দেখা করতে যোগ্য শিক্ষকরা: