Recruitment

Srikanta: “পাতা কুড়িয়ে দুই ছেলেকে বড় করেছি…খোকন পড়াশোনায় খুবই ভালো!” ছোটো ছেলের চাকরি হারানোয় ভেঙে পড়লেন বৃদ্ধা মা

দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১১ মার্চ: কিছুই জানতেন না তিনি! রোজকার মতো শনিবার সকালেও জঙ্গলে গিয়েছিলেন পাতা কুড়োতে, মহুল কুড়োতে। দুপুরে এদিন আর রান্না করার সময়ও হয়নি। পাশের বাড়িতেই খেয়ে নিয়েছিলেন। পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে কিছুজন অবশ্য আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন। বাইরের লোকজন (সাংবাদিকরা) আসতে পারে, তুমি লুকিয়ে যাবে! না, কোনো দিনই সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাননি লক্ষ্মী রানী মাহাতো। এদিনও তিনি সাংবাদিকদের দেখে লুকিয়ে যাননি! বরং জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে বাবা? বলতো তোমরা কি হয়েছে? আমি তো কিছুই জানিনা। এই একটু আগে জঙ্গল থেকে ফিরে এসে, স্নান করে, ওদের বাড়িতে (আঙুল দিয়ে প্রতিবেশীর বাড়ি দেখান) দু’টি খেয়ে, একটু বসেছিলাম। তোমরা আমাদের বাড়ির ছবি তুলছো দেখে এলাম। কি হয়েছে বাবা?” আপনার ছোটো ছেলের চাকরির বিষয়ে একটু ‘সমস্যা’ হয়েছে, কিছু শুনেছেন? সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা বললেন, “না তো বাবা। কিছুই জানিনা। তবে, পাড়ার লোক একটু আগে বলছিল, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে, তুমি বলবে, কিছু জানো না। আর, নাহলে লুকিয়ে যাবে।” আদালতের নির্দেশে আপনার ছোটো ছেলের চাকরি আপাততো বাতিল করা হয়েছে, অভিযোগ আপনার বড় ছেলে (মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতো) প্রভাব খাটিয়ে ওর (খোকন মাহাতো’র) চাকরি করে দিয়েছিলেন! একথা শোনার পরই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলঘেরা শালবনীর একদা মাও অধ্যুষিত প্রত্যন্ত কয়মা গ্রামের নিখাদ মাটির মানুষ, আপাত সহজ-সরল প্রৌঢ়া লক্ষ্মী রানী মাহাতো প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন!

ভাঙা মাটির বাড়িতে মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতোর মা লক্ষ্মী রানী মাহাতো (নিজস্ব চিত্র):

বললেন, “হতেই পারে না! খোকন আমার ছোট থেকেই পড়াশোনা ভালো। পাড়ার সবাই জানে। তোমরা (সাংবাদিকরা) পাড়ায় যাকে খুশি জিজ্ঞেস কর। সবাই বলবে, ও পড়াশোনা নিয়েই থাকতো। প্রথমে অঞ্চল অফিসে একটা কাজ (গ্রাম রোজকার সেবক/GRS) করতো। অনেক দূর পর্যন্ত পড়েছে। হাতের লেখা দেখলে তোমরা আশ্চর্য হয়ে যাবে। প্রাইমারি-টাইমারি সব পরীক্ষায় পাস করেছিল। ওর দাদা মন্ত্রী বলে এটা সবাই রটানোর চেষ্টা করছে। শত্রুর তো অভাব নাই। তারাই এসব করছে।” এরপরই তাঁর সটান প্রশ্ন, “হ্যাঁ বাবা এরপর কি হবে?” তাঁকে বোঝানো হয়, “আদালতের নির্দেশে যা হওয়ার হচ্ছে, ভবিষ্যতেও তাই হবে।” কিন্তু আপনি কি কিছুই জানতেন না? খোকন শেষ কবে বাড়িতে এসেছিল? কোথায় থাকে সে? বৃদ্ধা এবার একে একে বললেন, “না বাবা আমি কিছুই জানিনা। অনেক কষ্ট করে ওদের দু’ ভাইকে (মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতো ও তাঁর ভাই খোকন মাহাতো) পড়াশোনা করিয়েছি। ওর বাবা ঘর ছাওয়ার (মাটির ঘর খড় দিয়ে ছাওয়ার কাজ) কাজ করতো। আর, আমি জঙ্গল থেকে কাঠ, পাতা, মহুল কুড়িয়ে বিক্রি করতাম। সেই অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে। আজও গিয়েছিলাম। পাড়া-প্রতিবেশীরা অনেক কথা বলে। বলে তোমার ছেলে মন্ত্রী! তাতে কি। আমি বলি, যতক্ষণ শরীরে শক্তি আছে, করে যাব। এই সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই ওদের বাবা মারা যান। তারপর কষ্ট আরও বাড়ে। এই যে মাটির ঘরটা দেখছো। এই ভাঙা ঘরেই কষ্ট করে দুই ছেলেকে নিয়ে থেকেছি। কিন্তু, খোকন দিনরাত পড়াশোনা করত। বড় ছেলেও (মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতো) পড়াশোনায় ভালো ছিল। আর, ও (শ্রীকান্ত মাহাতো) খুব পরোপকারী ছিল ছোটো থেকেই। কোনোদিন ঘরের জন্য কিছু করেনি, সব বাইরের লোকেদের জন্য করেছে। এই যে পাকা ঘরটা (বছর তিনেক আগে তৈরি হওয়া একতলা পাকা বাড়ি) দেখছ, এটাও বারবার করে সবাই বলার পর কষ্ট করে করেছে। ওর ভাইয়ের চাকরি করে দিলে তো, অনেক আগেই করে দিতে পারতো। হ্যাঁ, এটা ঠিক, সবাই এখন এটাই বলবে। দাদা মন্ত্রী তো! কি আর করা যাবে, উপরে ভগবান আছে। সব দেখছেন। তিনিই যা বিচার করার করবেন।” এরপরই বৃদ্ধার চোখ ছলছল করে ওঠে। কথা বলতে বলতে, মাওবাদী পর্বে বড় ছেলে শ্রীকান্ত মাহাতোর লড়াইয়ের কথাও স্মরণ করেন। স্মরণ করেন, দুই ছেলেকে কষ্ট করে বড় করার কথা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শুক্রবার (১০ মার্চ) কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতোর ভাই খোকন মাহাতো সহ ৮৪২ জনের চাকরি বাতিল করা হয়েছে শনিবার (১১ মার্চ) দুপুরে। এরপরই, শনিবার বিকেল ৩টা নাগাদ মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতো এবং তাঁর ভাই খোকন মাহাতো’র কয়মার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা মাটির বাড়ির উঠোনে একাকী বসে আছেন তাঁদের বৃদ্ধা মা। তিনিই জানান, “খোকন আগে এখানেই থাকতো। এখন স্ত্রী, ছেলেকে নিয়ে মেদিনীপুরে ভাড়া বাড়িতে থাকে। তবে, মাঝেমধ্যে আসে। ৩-৪ দিন আগে এসেছিল। আর, বড় ছেলে এখন খুবই ব্যস্ত। আসারই সময় পায়না! এলেও ৫-১০ মিঃ থাকে।” এরপরই, বেঙ্গল পোস্টের তরফে, কয়মা গ্রাম থেকেই ফোন করা হয় খোকন মাহাতো-কে। শুক্রবার ফোন না ধরলেও, শনিবার ফোন ধরেন খোকন। বলেন, “আমি লিখিত পরীক্ষায় পাস করে কম্পিউটার টেস্ট এবং ইন্টারভিউ (পার্সোনালিটি টেস্ট) দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম। তারপর স্কুল সার্ভিস কমিশন রেকমেন্ডেশন দিয়েছে এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সেই অনুযায়ী নিয়োগ বা এপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে। এখন, পাঁচ বছর পর আদালতের কাছে স্কুল সার্ভিস কমিশন বলছে আমাদের নাকি ওএমআর (OMR) বিকৃত করা হয়েছে। কোথায় কি, বিকৃত হয়েছে তা আমি জানিনা। এসএসসি-ই তা বলতে পারবে। এমনকি আমরা কত নম্বর পেয়েছি, তাও জানিনা। সবার আগে এসএসসি’র কাছে আরটিআই করে নিজের নম্বর জানতে চাইবো। তারপর, পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।” শনিবার দুপুরে ফোনে এমনটাই জানিয়েছেন মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতোর ভাই খোকন মাহাতো। তিনি এও বলেন, “আমি বিএসসি পাশ করেছি। পরবর্তী সময়ে লাইব্রেরী সাইন্সে এমএসসি করেছি। ২০১৪ সালের প্রাইমারি টেট পরীক্ষা সহ একাধিক পরীক্ষায় পাশ করেছি। ২০১৭ সালে গ্রুপ-সি পরীক্ষা দিয়েও পাস করি। তারপর, কম্পিউটার টেস্ট এবং পার্সোনালিটি টেস্ট কোয়ালিফাই করে মেধাতালিকায় জায়গা পাই। এমনকি, আমি ২০২০ সালে সেট (SET) কোয়ালিফাইও করেছি।” প্রতিবেশীদের মধ্যে কেরানী মাহাতো কিংবা নারায়ণ মাণ্ডিরাও এক বাক্যে স্বীকার করে নেন, “খোকন ছোট থেকেই পড়াশোনায় খুব ভালো। তবে, আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ! কিভাবে চাকরি পেয়েছে, কবে পেয়েছে তা বলতে পারবোনা।” শুধু খোকন বা তাঁর প্রতিবেশীরাই নয়, এই মুহূর্তে চাকরি যাওয়া বা চাকরি যেতে চলা রাজ্যের হাজার হাজার প্রার্থী এবং তাঁদের পরিবার-পরিজনেরাও যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, যোগ্যতা থেকেও যে লাভ ছিলোনা! সেই সময় (২০১৩-‘১৪’র পর থেকেই) যোগাযোগ কিংবা অর্থ-যোগ ছাড়া যে সকলের (সকল যোগ্য‌ প্রার্থীর) চাকরি পাওয়ার উপায় ছিলোনা! খোকন সহ চাকরি যাওয়া অনেক শিক্ষক কিংবা শিক্ষাকর্মীকেই হয়তো সেই ‘সিস্টেম’ এরই বলি হতে হয়েছে! এমনটাই বলছেন রাজ্য তথা জেলার সচেতন নাগরিকরা।

মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতোর সঙ্গে ভাই খোকন মাহাতো (ফাইল চিত্র) :

News Desk

Recent Posts

Ghatal Flood: নদীতেই ‘রোপওয়ে’? চন্দ্রকোনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পড়ুয়াদের যাতায়াত; প্লাবিত ঘাটালে তলিয়ে মৃত্যু এক ব্যক্তির

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৮ আগস্ট: বানভাসি ঘাটালের দুর্যোগের নানা চিত্র! কোথাও সেতু…

7 hours ago

Midnapore: স্ত্রী-র পরকীয়া ধরে ফেলেছিলেন, ভাতের সাথে বিষ মিশিয়ে পুরো পরিবারকেই খুনের ছক, মৃত্যু স্বামীর; সিনেমাকেও হার মানাবে ডেবরার ঘটনা

শশাঙ্ক প্রধান, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৬ আগস্ট: স্ত্রী-র পরকীয়ার বলি স্বামী! মৃত স্বামীর নাম বুদ্ধদেব দোলাই…

2 days ago

Medinipur: গড়বেতার নির্জন এলাকায় রেললাইনে হঠাৎ বিকট ‘শব্দ’, থমকালো রাজধানী! নমুনা সংগ্রহের পর ফরেন্সিক দল যা জানাল…

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৫ আগস্ট: শিলাবতী নদীর উপর রেলওয়ে ব্রিজ। তার উপরই…

4 days ago

Midnapore: একদিকে চন্দ্রযান, অন্যদিকে হরিনাম; শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান-ক্রীড়া ও পরিবেশের অভূতপূর্ব মেলবন্ধন বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতনের বার্ষিক প্রদর্শনীতে

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৩ আগস্ট: আধুনিক যুগের বিজ্ঞান থেকে সনাতন সংস্কৃতি, যোগব্যয়াম-খেলাধুলার…

6 days ago

Kharagpur: নতুন কারখানায় কাজ শুরু করবে রশ্মি মেটালিক্স, বাধা সৃষ্টি হলে পুলিশের পদক্ষেপ; নির্দেশ আদালতের

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৩ আগস্ট: নতুন কারখানায় অবিলম্বে কাজ শুরু করতে পারবেন…

6 days ago

Midnapore: মেদিনীপুরের একটি বুথেই ৪৯ জন ‘মৃত’ ভোটার, মৃত্যুর ৭ বছর পরও বাদ পড়েনি নাম! প্রশাসনের ঘাড়েই দায় চাপালেন BLO

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২ আগস্ট: SIR-এর নিয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্য-রাজনীতি উত্তাল। এই ইস্যুতে…

6 days ago