দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৮ অক্টোবর: “বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে…”। সেই বিদ্যাসাগরের মাতৃভূমি মেদিনীপুর। মেদিনীপুর (বর্তমান, পশ্চিম মেদিনীপুর) এর একটি পুরো গ্রামই ডুবে ছিল অশিক্ষার অন্ধকারে! ছোট্ট গ্রাম। তাই, পাড়া হিসেবে পরিচিত। সবংয়ের বাগালপাড়া। এই পাড়ায় বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় একশো হলেও, চতুর্থ শ্রেণির গন্ডী টপকেছে মাত্র একজনই! আর, এ যাবৎকালে বিদ্যালয়ের মুখও দেখেছে হাতে গোনা কয়েকজন, সর্বোচ্চ শিক্ষিত চতুর্থ শ্রেণি পাস একজন। শুধু তাই নয়, এরা বঞ্চিত সরকারি অন্যান্য সুবিধা থেকেও। জাতিতে খেড়িয়া শবর হলেও, সব ধরনের স্বীকৃতির বাইরে এদের অবস্থান। নিজেদের অধিকারবোধ সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা না থাকায়, সরকারি যে সকল জনহিতকর প্রকল্প রয়েছে, সেসবের সুযোগ থেকে এঁরা বঞ্চিত। আসলে, শিক্ষার আলোটুকুই যদি না পৌঁছয়, নিজেদের প্রাপ্য বা অধিকারবোধ সম্পর্কে ধারণা জন্মাবেই বা কি করে! পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবংয়ের ৩ নং দাঁররা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন খোলাগেড়্যা মৌজার সেই ‘বাগালপাড়া’ তেই খুলে গেল ‘বর্ণপরিচয় পাঠশালা’। সৌজন্যে দুই শিক্ষক। শান্তনু অধিকারী এবং ভাস্কর ব্রত পতি-র ‘বর্ণপরিচয়’ এর হাত ধরে মহালয়ার পুণ্য লগ্নে শুরু হল ‘অ আ ক খ’ পড়াশোনা।

thebengalpost.net
বর্ণপরিচয় :

উল্লেখ্য, প্রায় পাঁচ দশক ধরে একটি পুকুরকে ঘিরে এখানকার প্রায় তিরিশটি পরিবারের বসবাস। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাড়াটির দূরত্ব মেরেকেটে আটশো মিটার। অথচ সেই স্কুলের চৌকাঠ মাড়ায়না এখানকার শিশুরা। যে বয়সে হাতে খাতা-কলম থাকা উচিত, সেই হাতে তখন জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা কাঠ, ডালপালা ভরা থাকে! যে বয়সে পিঠে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে চলা উচিত, সেই বয়সে মাথায় চাপে মজুর খাটার নির্দেশ! “পড়াপাঠ আর ভরা পেট” এঁদের জীবনের অঙ্গ নয়! পাড়া জুড়ে চোলাই মদের অফুরন্ত জোগান। এখানে তাই শৈশব থেকেই নেশায় আসক্তি। নাবালক অবস্থাতেই বিয়ে, সন্তান ধারণ। রয়েছে চূড়ান্ত অভাব, বঞ্চনা আর অপুষ্টি। প্রতিদিন বাড়িতে চুলা জ্বলে না। হাঁড়িতে চাল পড়ে না। ভুখা পেটে কেটে যায় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রায় সকলেই। সকলেই ভূমিহীন। ভিক্ষা ও দিনমজুরিই উপার্জনের একমাত্র উপায় হলেও, রোজগারের সিংহভাগই খরচ হয় নেশার পেছনে। ফলে নেই কোন মানসিক বিকাশ। আর, তাই শিক্ষার বিকাশটুকুও মুখ থুবড়ে। পরের বাড়িতে চেয়েচিন্তে আর মেগেপেতে জোগাড় করা সামগ্রীতেই ক্ষুন্নিবৃত্তি কোনো রকমে।এমতাবস্থায় একেবারেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেই স্কুলবিমুখ বাগালপাড়ার দুয়ারেই ‘বর্ণপরিচয়’ নামে একটি পাঠশালা স্থাপন করে এলাকার ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দানের কর্মসুচী গ্রহন করা হোলো মহালয়ার দিন। অর্থাৎ দেবী পক্ষেই এই পাড়ায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হল দুই শিক্ষকের উদ্যোগে। সবংয়ের শিক্ষক শান্তুনু অধিকারী এবং তমলুকের শিক্ষক ভাস্কর ব্রত পতি। যাঁদের বর্ণের সাথে সামান্যতম পরিচয়টুকুও হয়নি তাঁদের হাতে স্লেট, খড়ি, খাতা, কলম আর বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ তুলে দিয়ে অক্ষরজ্ঞান করানোর প্রচেষ্টায় শুরু হল “বর্ণপরিচয়” পাঠশালা। পড়াশোনা শেষে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছে। দুই শিক্ষকের মতে, একমাত্র শিক্ষাই পারে যথার্থ পরিবর্তন আনতে। যাবতীয় সামাজিক কলুষতা নির্মূল করতে পারে বর্নপরিচয়ের অক্ষরজ্ঞান। তাঁরা জানালেন, আপাতত এই পাঠশালা চলবে সপ্তাহে চারদিন। নিয়োজিত হয়েছেন একজন শিক্ষিকাও। উদ্দেশ্য, ছোটদের পাশাপাশি এখানকার বড়দেরও অক্ষর পরিচয় করিয়ে সাক্ষর করে তোলা। শুধু তাই নয়, শিক্ষিত চেতনার বিকাশসাধনের মাধ্যমে যাবতীয় অন্ধকার থেকে এখানকার মানুষজনদের মুক্ত করাও ‘বর্ণপরিচয়’-এর প্রাথমিক লক্ষ্য।

thebengalpost.net
পড়াশোনা শেষে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা :