Special Article

“দাঁতনের মোঘলমারি-র মতোই খননকার্য হোক শালবনীর কর্ণগড়ে, উদ্ধার হবে অজানা ইতিহাস”, জোরালো হচ্ছে দাবি

দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, নিসর্গ নির্যাস মাহাত, ৩ আগস্ট: “কর্ণগড়ের রানী মাগো অস্ত্র ধরেছিল/কোলকাতার লোকে উকে চুয়াড় বলেছিল!” (লোক সংগীত)। বিদ্রোহী রানী বললেই কার কথা মনে পড়ে? শুধু ঝাঁসির লক্ষ্মীবাই? সেটাই স্বাভাবিক কারণ, ভুলিয়ে দেওয়া হয় বাংলার কথা। এই মাটির বিপ্লবের কথা। নারীর কথা। ইতিহাস বারবার বিকৃত হয়। করা হয় আসল ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে। তেমনই চেষ্টা করা হয়েছে মেদিনীপুরের এই ইতিহাসকে আস্তে আস্তে মুছে ফেলার। অবহেলা নয়। পরিকল্পিতভাবেই হারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে আমার অবিভক্ত মেদিনীপুরের এই ইতিহাস। আসলে বাংলার নারীর দাপটের এই ইতিহাসে ফিকে হয়ে যাবে অবাঙালি দাপট। রানী লক্ষীবাইয়ের জন্ম ১৮২৮ সালে। তাঁর জন্মের ১০ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন বিদ্রোহী রানী শিরোমনি। অথচ হারানো ইতিহাসে কান পাতলে শোনা যায় শিরোমনি মানে ‘মেদিনীপুরের লক্ষীবাই’। কখনো কোথাও শুনেছেন লক্ষীবাইকে ‘ঝাঁসির শিরোমনি’ বলতে? দুই মহিয়ষী নারী রাজ্যের জন্য আপ্রাণ লড়াই করেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। তবু বাংলা আর বহি:বাংলার এই নোংরা খেলাটা শুরু হলো দেশেই।

কর্ণগড়

বিপ্লব মানেই তার সূত্রধর মেদিনীপুর। এই অঞ্চলের মাটি, গাছ, জল শেখায় প্রাণভরে ভালোবাসতে। আর সেই ভালোবাসায় আঘাত নেমে এলে গর্জে ওঠে আমার মেদিনীপুর। যা এখন হয়, তা হয়ে গেছে বহু বহু বছর আগেও। কারণ এই অঞ্চল যে বিপ্লবের আঁতুড়ঘর। কেশরী বংশের আগে রাজা ইন্দ্রকেতু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উত্তরসূরী নরেন্দ্রকেতু রাজ্যের দায়ভার তুলে দেন লোধা সর্দার রণবীর সিংহের হাতে। অপুত্রক রাজা ভবিষ্যতের শাসক হিসেবে দত্তক নেন জনৈক মাঝি অভয়ার পুত্রকে। তারপর পারাং নদী দিয়ে বয়ে গেছে রাজ্যপাটের স্মৃতিমোড়া কত জল। ক্ষমতার দিক থেকে তাঁর উত্তরসূরী রাজা অজিত সিংহের মৃত্যুর পরে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার তুলে নেন দ্বিতীয় রানী শিরোমণি।‌‌

কর্ণগড়

রানীর তখন ৩ টি গড়, কর্ণগড়, আবাস গড়, জামদার গড়। সমগ্র কর্ণগড় জনপদ ছিল পরিখা ঘেরা। টিলার উপর রাজপ্রাসাদ। রাজ্য পরিচালনা করতেন অপুত্রক রানী শিরোমণি। সন্তানহীন কি? বোধহয় ভুল। তিনি গর্ভধারিনী নন। সমস্ত প্রজাই তাঁর সন্তান। পরম যত্নে আগলে রাখেন রাজ্যবাসীকে। কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে হিংস্র শাসক চোখ ঠিকরে পড়ল শান্ত জঙ্গলের গর্ভে। স্থানীয় জমিদারদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল চড়া ভূমি রাজস্ব। যা আদায় করতে গেলে শেষ হয়ে যাবে ভূমিপুত্রদের জঙ্গল, নিষ্কর জমির অধিকার। সরব হয়ে উঠল পাইক-বরকন্দাজরা। জঙ্গলের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল প্রতিবাদ। প্রতিবাদকে শুরুতেই শেষ করে দিতে লোপ করা হলো পাইকান পেশা, বাতিল করা হয় জমির অধিকার। আরো তীব্র হলো প্রতিবাদ। টিলার ওপরে মাকড়া পাথর ও পোড়া ইঁটের রাজপ্রাসাদ হয়ে উঠল বিপ্লবের আঁতুড়ঘর। কুলদেবী মহামায়ার রাজ্য রক্ষা করতে রানী দেবী আখ্যান প্রচার করতে শুরু করেন গোপনে। বিপ্লবের জন্য ব্যয় করতে থাকেন দু’হাত উজাড় করে। হয়ে ওঠেন নেত্রী। মূলত এই কৃষক বিদ্রোহকে ইংরেজরা হেঁয় করার জন্য নাম দিল ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’।

কর্ণগড়

এর আগেও জগন্নাথ সিংহের নেতৃত্বে হয়েছে বিপ্লব। এবার তা আরও তীব্র। সম্মুখে এসে বিদ্রোহ করলেন রাইপুরের দুর্জন সিং-ও। নিজেকে ঘোষণা করলেন স্বাধীন তালুকদার হিসেবে। বিপ্লবের জন্য অর্থ ব্যয় করতে করতে রানীর বাকি পড়েছে খাজনা। ‘নানাকর’ আদায়ে চাপ দিতে শুরু করে শোষক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। রাজ্যের লোভে বিশ্বাসঘাতকতা করলো রানীর দেওয়ান যুগলচরণ। গোপনে খবর পৌঁছে যেতে থাকল সাদা চামড়ার শাসকদের কাছে। তা অবশ্য চোখ এড়ায়নি প্রজাপালিতার। জমিদারি থেকে নয়াবসত পরগনার রানী (কুড়মি?) বিতাড়িত করলেন তাকে। নিযুক্ত করলেন এককালের বরখাস্ত চুনীলালকেই।

কর্ণগড়

দাউ দাউ করে জ্বলছে বিপ্লবের আগুন। ১৭৯৮ সালে প্রায় ৪০০ ‘চুয়াড়’ তীর-ধনুক, বল্লম, লাঠি, আগুন নিয়ে লুঠ করতে শুরু করল সরকারি অফিস, গুদামঘর। বিদ্রোহ দমন করতে এসে বিনা খাদ্য, জলে বন্দি ইংরেজবাহিনী। এদিকে কালেক্টরেট থেকে খবর গিয়েছে কোম্পানিতে। মেদিনীপুরে আসতে শুরু করেছে ইংরেজ সেনাবাহিনী। রানীর কাছে পৌঁছাল সেই খবর। শেষ আঘাত হানতে ব্লুপ্রিন্ট কষলেন কুড়মি রানী। কালেক্টরেটে খবর পাঠালেন, চুয়াড়দের দমানো যাচ্ছে না। তিনি কোম্পানির সঙ্গে সন্ধি করতে প্রস্তুত। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রানীর কথা বিশ্বাস করার সাহস দেখালো না সাদা চামড়ার বেনিয়ারা। ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বন্দি করা হলো চুনীলালকে। তিনিই সেনাপতি। গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হলো বনসুরাম বক্সীর বিরুদ্ধে। গোলা, বারুদ, বন্দুক নিয়ে ইংরেজ সৈন্য ঘিরে ফেলেছে দুর্গ। সুড়ঙ্গ দিয়ে কর্ণগড় থেকে আবাস গড়ে যাওয়ার পথে বন্দি করা হল রানীকে। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সেই প্রথম রাজনৈতিক বন্দি। হেসে উঠল ইলবার্ট। জঙ্গলের গাছে গাছে ঝুলছে বিদ্রোহীদের দেহ। রক্ত আর অশ্রু মেখে হাহাকার করছে পারাং। এদিকে গোলার আঘাতে আগেই প্রাণ হারিয়েছেন রাজা দুর্জন সিং। সময়টা ১৭৯৯ সালের ছয় এপ্রিল। জনদরদী রানীকে বন্দী করে নিয়ে আসা হল আবাসগড়ে। পরদিন কলকাতায়। প্রিভি কাউন্সিল থেকে আদেশ এল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের।নাড়াজোলের রাজা আনন্দলাল খানের মধ্যস্থতায় শিরোমণি গৃহবন্দি থাকলেন আবাসগড়ে। ১৮১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন জনগণের দেবী। গৃহবন্দি থাকা অবস্থাতে স্বাভাবিকভাবেই না কি গুপ্তহত্যা? সেই প্রশ্ন আজও তোলে জঙ্গলের প্রতিটি গাছ, গড়ের ধ্বংসস্তূপ। ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে।

সৌন্দর্যায়ন (ছবি- শুভদীপ সাহা ও সুমন জানা) :

অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কর্ণগড়ের গড়ে সৌন্দর্যায়ন হচ্ছে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে। উদ্যোগী স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-ও। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, সৌন্দর্যায়নের পাশাপাশি বেশ কিছু জায়গা চিহ্নিত করে খননকার্য হোক। পাথরা, মোঘলমারির মতো নিদর্শন উঠে আসতে পারে। সেইসঙ্গে অনুরোধ গড়ের পাথর পরীক্ষা করে প্রাসাদ নির্মাণের আনুমানিক সময়সীমা লিপিবদ্ধ করা হোক। রানী শিরোমণির কাল্পনিক মূর্তি স্থাপন করা হোক। চালু হোক ওয়াটার এন্ড লাইট শো। আমাদের এই দাবিগুলিকে ব্যক্তিগত ভাবে সমর্থন জানিয়েছেন জেলা তথা অবিভক্ত মেদিনীপুরের অনেক বিখ্যাত মানুষ।

সৌন্দর্যায়ন (ছবি- শুভদীপ সাহা ও সুমন জানা) :

১. সমর্থন জানিয়েছেন প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক সমীর রায়।
২. আমাদের লড়াইয়ে সবরকম ভাবে পাশে থাকার আশ্বাস দিল পশ্চিম মেদিনীপুর বাংলাপক্ষ
৩. আমাদের দাবিকে সমর্থন জানালেন ডিওয়াইএফআই- এর প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তাপস সিনহা
৪. আমাদের লড়াইয়ে সব রকম ভাবে পাশে থাকার আশ্বাস দিল কুড়মি সেনা
৫. আমাদের দাবিকে ব্যক্তিগত ভাবে সমর্থন জানালেন ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেণ)- এর নেত্রী বীরবাহা হাঁসদা (এখন তৃণমূল বিধায়ক)
৬. আমাদের দাবিকে ব্যক্তিগত ভাবে সমর্থন জানালেন এবিভিপি নেতা সৌরিণ গোস্বামী
৭. আমাদের দাবিকে পূর্ণ সমর্থন করলেন প্রখ্যাত উপন্যাসিক, গল্পকার, কবি সুমন মহান্তি
৮. আমাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিলেন লোক সাহিত্য গবেষক চিণ্ময় দাস
৯. আমাদের দাবিকে সমর্থন করে একসাথে লড়াইয়ে সামিল হলেন কুতুরিয়া জুনিয়র হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অরুণাংশু দে। তিনি দীর্ঘ বছর ধরে কর্ণগড় ও রাণি শিরোমনি নিয়ে গবেষণা করেছেন। গড়ে তুলছেন আর্কাইভ। তৈরি হচ্ছে রাণির কাল্পনিক মূর্তি।
১০. খননকার্যের দাবিকে সমর্থন করলেন বিধায়ক শ্রীকান্ত মাহাতো
১১. আমাদের দাবিকে সমর্থন জানালেন মন্দিরময় পাথরার প্রাণ পুরুষ মহ: ইয়াসিন পাঠান
১২. আমাদের দাবিকে সমর্থন করলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক নলিনী বেরা
১৩. আমাদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানালেন প্রাক্তন সাংসদ, সাংবাদিক, লেখক কুণাল ঘোষ
১৪. আমাদের দাবিকে পূর্ণ সমর্থন করে পাশে থাকার অঙ্গীকার করল ওয়েস্ট মিডনাপুর সাইক্লার্স ক্লাব।

সৌন্দর্যায়ন : (ছবি- শুভদীপ সাহা ও সুমন জানা)

News Desk

Recent Posts

Midnapore: শিক্ষা, সাহিত্য, সঙ্গীতের সাথেই মিশে গেল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছটা; ঈশ্বরের আলোয় আলোকিত ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’-এর মঞ্চ

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৫ সেপ্টেম্বর: শিক্ষা, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সমাজজীবনে উল্লেখযোগ্য অবদানের…

19 hours ago

Midnapore: সকাল থেকেই চলছিল অভিযান, পুজোর আগেই কেশিয়াড়ি থেকে পাকড়াও মহারাষ্ট্রের দুই কুখ্যাত দুষ্কৃতী

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৩ সেপ্টেম্বর: গোপন সূত্রে খবর পেয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকেই…

2 days ago

IIT Kharagpur: শত চেষ্টাও বিফলে, ন’মাসে ছয় পড়ুয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যু IIT খড়্গপুরে; ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার গবেষকের

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২১ সেপ্টেম্বর: ফের ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার আইআইটি খড়্গপুরে! শনিবার…

4 days ago

Midnapore: দুর্ভেদ্য নাকা পয়েন্ট, স্টেশন চত্বরে বসছে CCTV; মেদিনীপুরে কুড়মি আন্দোলন ঠেকাতে কড়া জেলা পুলিশ ও রেল

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৯ সেপ্টেম্বর: 'কেউ কথা রাখেনি..!' না রাজ্য সরকার না…

7 days ago

IIT Kharagpur: বিশ্ব উষ্ণায়ন আর মানব সভ্যতার বিবর্তন, বনাঞ্চলে ব্যাহত সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া; IIT খড়্গপুরের গবেষণায় উঠে এলো চমকপ্রদ তথ্য

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, খড়্গপুর, ১৯ সেপ্টেম্বর: গত কয়েক বছরে সবুজায়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে ভারত।…

7 days ago

Midnapore: বাড়ি নয় যেন ‘হাজারদুয়ারি’! কোটি কোটি টাকা প্রতারণা করে সপরিবারে ‘ফেরার’ বেলদার স্বর্ণ ব্যবসায়ী

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৬ সেপ্টেম্বর: বিশাল জায়গার উপর প্রাসাদোপম বাড়ি। উঁচু পাঁচিল…

1 week ago