দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, মেদিনীপুর, ৩ অক্টোবর: যার ভরসায় নিজেদের ১০ মাসের শিশুকন্যাকে বাড়িতে রেখে স্বাস্থ্য পরিষেবায় নিয়োজিত থাকেন চিকিৎসক দম্পতি, সেই ‘মাতৃসমা’ পরিচারিকাই ফুলের মতো ফুটফুটে শিশুকন্যা-কে তুলে আছাড় দিচ্ছে বিছানায়! সঙ্গে কান্না থামানোর জন্য চড়-থাপ্পড় তো আছেই। এমনই নির্মম দৃশ্য CCTV ক্যামেরার মাধ্যমে নিজের মোবাইল অ্যাপে দেখে আঁতকে উঠলেন শিশুকন্যার বাবা ডাঃ দেবাশীষ দাস। স্ত্রী নবমিতা সেই দৃশ্য দেখলে মূর্ছা যেতে পারেন, তাই তাঁকে ফোনে তা ফরোয়ার্ড করতেও ভয় পেলেন। শুধু বললেন, “মেয়ের উপর অকথ্য অত্যাচার করছেন কল্পনা দি (কল্পনা সেন, অভিযুক্ত পরিচারিকা), তুমি এক্ষুনি বাড়িতে যাও।” পূর্ব মেদিনীপুর জেলা স্বাস্থ্য ভবনে কর্মরতা স্ত্রী ডাঃ নবমিতা ভট্টাচার্য (দাস) তখন স্পট ভিজিটে কোনো এক গ্রামে গিয়েছেন; মেছোগ্রামে নিজেদের ভাড়া বাড়িতে (আবাসনে) ফিরবেন কি করে! দেবাশীষ আছেন বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে নিজের ডিউটিতে। এই পরিস্থিতিতে, নবমিতা নিজের বাপের বাড়ি মেদিনীপুর শহরে ফোন করেন। তাঁর মা-ও একজন স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁকেই বলেন, দ্রুত মেছোগ্রামে পৌঁছে যেতে। তিনি দেড়-দু’ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যান। দেখেন, নাতনি আপাতভাবে সুস্থ আছে, তবে মুখ-চোখ শুকিয়ে গেছে। শনিবার দুপুরে মেদিনীপুর শহরে নবমিতার বাপের বাড়িতে বসে, এমনই হাড়হিম করা ঘটনার বিবরণ দিলেন দেবাশীষ ও নবমিতা।

thebengalpost.net
বাবার কোলে ছোট্ট নীলিঞ্জিতা :

বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজের প্যাথলজি বিভাগে এম.ডি পাঠরত চিকিৎসক ডাঃ দেবাশীষ দাস এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলা স্বাস্থ্য ভবনে কর্মারতা জেলা জনস্বাস্থ্য অফিসার ডাঃ নবমিতা ভট্টাচার্য (দাস) এর দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী, দু’জন দু’জায়গায় জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত। কোভিড কালে দায়িত্ব আরও বেড়েছে। এদিকে, দেবাশীষের বাড়ি হাওড়া জেলায়, তাঁর বাবা-মা’র যথেষ্ট বয়স হয়েছে। নবমিতার বাড়ি মেদিনীপুর শহরে। তাঁর মা-ও স্বাস্থ্য দপ্তরে কর্মরতা। ফলে তাঁদের ১০ মাসের শিশুকন্যাকে দেখার মতো কেউ নেই! অগ্যতা ভরসা সেই পরিচারিকা। গত ৫ বছর ধরে যিনি তাঁদের মেছোগ্রামের (পূর্ব মেদিনীপুর) ভাড়া বাড়িতে দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করে বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করেছেন, সেই পঞ্চাশোর্ধ কল্পনা সেন-এর উপরই তুলে দিয়েছিলেন, তাঁদের অনুপস্থিতিতে একমাত্র শিশুকন্যা নীলাঞ্জিতা-র দেখাশোনার দায়িত্ব। কিন্তু, গত বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টা-সাড়ে ১২ টা নাগাদ, নিজের মোবাইলের বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে সিসিটিভি বন্দী বাড়ির দৃশ্য দেখে আঁতকে ওঠেন দেবাশীষ। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে বসে দেবাশীষ নিজের মোবাইলে দেখেন, ওই দিন দুপুর ১২ টা নাগাদ তাঁদের ফুটফুটে শিশুকন্যা-র দু’পা ধরে শুন্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিছানায় আছাড় মারছেন কল্পনা! শিশুটির অপরাধ বার বার চেষ্টা করার পরেও ঘুমোচ্ছে না, উঠে পড়ছে! আর সেই সময়ই ফোন চলে আসে, কল্পনার। ব্যাস! ফুলের মতো শিশুর উপর নেমে আসে নির্মম অত্যাচার! এরপরই, দেবাশীষ তাঁর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ঘটনার কথা জানান এবং মোবাইলে সব দেখান। তাঁরা বলেন, “তুমি এক্ষুনিই ট্রেনের টিকিট কেটে চলে যাও!” তার আগে, নবমিতা-কেও সব জানান, শুধু ভিডিওটি ফরোয়ার্ড করেননি, নবমিতা সহ্য করতে পারবেন না বলে! তবে, ডিউটিতে থাকা প্রত্যন্ত একটি গ্রাম থেকে দ্রুত ফিরতে পারবেন না বলে, নিজের মা-কে সব জানান নবমিতা। তিনিই ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে সেখানে (মেছোগ্রামে) পৌঁছন। সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসেন দেবাশীষ ও নবমিতা। কল্পনা-কে তার আগে পর্যন্ত কিছুই জানাননি তাঁরা। বাড়ি ফিরে এসে, কল্পনা-কে সব বললে, তার ঠান্ডা মাথার সাফাই- “ও তো ওর সাথে আমি খেলছিলাম। ওটা আর এমনকি। মাঝেমধ্যে করি!” মাথা ঠিক রাখতে পারেননি নবমিতা। বলেন, পরের দিন থেকে আর কাজে আসার দরকার নেই! ১ অক্টোবর থানায় পাঁশকুড়া থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ কল্পনা-কে গ্রেফতার করে শনিবার আদালতে তুলেছিল বলে জানা গেছে।

thebengalpost.net
১০ মাসের নীলাঞ্জিতা :

তবে, মেদিনীপুরের বাড়িতে বসে নবমিতা ও দেবাশীষ কল্পনা-র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’র দাবি জানালেন। যাতে কোনো পরিচারিকা এভাবে শিশুদের উপর নির্মম অত্যাচার করার সাহস না পায়! তুলে ধরলেন তাঁদের মতো কর্মরত বাবা-মায়েদের অসহায়তার কথা। নবমিতা বললেন, “দু’জনই জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত। বাড়ির লোকেরাও অসহায়। কিভাবে সন্তান প্রতিপালন করব আমরা? সিসিটিভি-র ফুটেজে আগে চোখ রাখা হয়নি, আগেও হয়তো এরকম করেছে! আমরা চরম আতঙ্কে আছি। সরকার একটু এই বিষয়গুলো নিয়েও ভাবুন। সারাদিনে অন্তত একবার যদি একটু বিরতি দেওয়া যায়! তাহলেও বাড়িতে গিয়ে দেখে আসতে পারি।” আপাতত সুস্থ আছে তাঁদের কন্যা নীলাঞ্জিতা। তবে, ভীতি যেন পুরোপুরি কাটেনি! যেভাবে দু’পা ধরে শুন্যে ঘুরিয়ে আছাড় মারা হয়েছে, তাতে ব্রেনে আঘাত পাওয়ার আশঙ্কাও থাকছে! শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ-কে দেখিয়েছেন। তিনি বলছেন, কয়েকটা দিন পর্যবেক্ষণে রাখতে। আর বাবা-মা’কে সময় দিতে। যদি বমি ভাব কিংবা নেতিয়ে পড়ার ভাব থাকে, তবে পুনরায় তাঁর কাছে অথবা হাসপাতালে নিয়ে যেতে! নিজেদের কন্যাকে জড়িয়ে ধরে তাঁদের একটাই আবেদন, “পৃথিবীর কোনো শিশুর সাথে যাতে এরকম না হয়!” (ভিডিওতে দেখুন সেই হাড়হিম করা দৃশ্য)