দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৯ অক্টোবর: জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটল! পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্যতম ঐতিহাসিক পর্যটনস্থল হিসেবে চন্দ্রকোনার ‘ফাঁসিডাঙা’ উদ্বোধন করলেন জেলাশাসক ড. রশ্মি কমল। উপস্থিত ছিলেন, ঘাটালের মহকুমাশাসক সুমন বিশ্বাস, চন্দ্রকোনা ২ নং ব্লকের বিডিও অমিত ঘোষ প্রমুখ। শুক্রবার সন্ধ্যা নাগাদ ফাঁসিডাঙা পর্যটনস্থলের উদ্বোধন করেন জেলাশাসক। উৎসাহী জনতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন সেই শুভক্ষণ-টির জন্য। উনবিংশ শতাব্দীর সেই ‘কুখ্যাত’ ও ঐতিহাসিক ফাঁসির মঞ্চ-কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিনোদন পার্কটি খুলে দেওয়া হল সর্বসাধারণের জন্য। ফলে, মোগলমারি, কর্ণগড়ে প্রভৃতির পর জেলায় বৃদ্ধি পেল আরও একটি ঐতিহাসিক পর্যটনস্থলের। পুজোর ঠিক মুখেই, দ্বিতীয়ার সন্ধ্যায় এই পার্কের উদ্বোধন ঘিরে স্বভাবতই এলাকাবাসীর উৎসাহ ছিল তুঙ্গে! প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এই পার্কটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে আনুমানিক ৭০ থেকে ৮০ লক্ষ টাকা।

thebengalpost.net
উদ্বোধন করলেন জেলাশাসক ডঃ রশ্মি কমল :

thebengalpost.net
উৎসাহী জনতা ভিড় করলেন প্রথম দিন থেকেই :

ঐতিহাসিক সূত্র ধরে জানা যায়, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী মেদিনীপুরের রাণী শিরোমণি ছিলেন দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহের (১৭৯৮-‘৯৯) নেত্রী। কর্ণগড়ের প্রাসাদ থেকে গোপন সুড়ঙ্গপথে মেদিনীপুরের আবাসগড়ে পালাতে গিয়ে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ে যান তিনি। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল রাণী বন্দিনী হলেন ইংরেজদের হাতে! “চুয়াড় বিদ্রোহ” (মূলত, আদিম উপজাতিদের ‘কৃষক বিদ্রোহ’, ইংরেজরা ঘৃণাভরে নাম দিয়েছিল ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’) এরপরও শেষ হয়নি, নতুন নতুন নামে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া সহ সমগ্র রাঢ়বঙ্গ ও ছোটনাগপুর অধ্যুষিত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। মেদিনীপুরের গড়বেতা, চন্দ্রকোনা, ক্ষীরপাই, কেশপুর, শালবনী, শিলদা, লালগড়, রামগড় প্রভৃতি এলাকায় “বাগড়ী নায়েক বিদ্রোহ” বা “পাইক বিদ্রোহ” রূপে এই আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। নেতৃত্বে ছিলেন গড়বেতার বাগড়ী রাজ বংশের রাজা ছত্র সিংহের বিশ্বস্ত পাইক সর্দার অচল সিংহ। তাঁর নেতৃত্বেই ১৮০৬ থেকে ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিম জনজাতি সম্প্রদায়ের (লোধা, শবর, সাঁওতাল, কোল, মুণ্ডা, ভূমিজ, বাগদী, কুড়মি প্রভৃতি) পাইক ও নায়েক’রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সেই সময় পাইক ও নায়েক-দের কাছ থেকে জমি (পাইকান জমি বলা হতো)’র অধিকার কেড়ে নেওয়া শুরু হয় এবং তাঁদের দিয়ে চাষিদেরকে নীল চাষ করাতে বাধ্য করা হয়। অন্যদিকে, পাইক’দের হাত থেকে নগর রক্ষার দায়িত্বও কেড়ে নিয়ে, তা দেওয়া হলো দারোগাদের হাতে। গর্জে উঠলেন পাইক-নায়েকরা। এদিকে, জমিদারদের হাত থেকেও সমস্ত ক্ষমতা ধীরে ধীরে কোম্পানির হাতে চলে যেতে লাগলো। এই পরিস্থিতিতে জমিদারদের সমর্থনে পাইক ও নায়েকদের আন্দোলন আরো তীব্র আকার ধারণ করে। হাজার হাজার চাষি, সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ইংরেজরাও অত্যাচারের সীমা বাড়ালো! রাতের অন্ধকারে আন্দোলনকারীদের মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো ল্যাম্প পোস্টে বা গাছের ডালে! তাতেও যখন আন্দোলন দমানো যায়নি, বরং তা গড়বেতা-চন্দ্রকোনা প্রভৃতি এলাকায় তীব্র আকার ধারণ করছে, সেই সময়ই ১৮১৫ সালে চার্লস রিচার্ড ও মিস্টার হেনরি নামে ২ জন অত্যাচারী ইংরেজ সৈন্যাধ্যক্ষকে পাঠানো হল এই এলাকায়। তারাই চন্দ্রকোনার বসনছড়া এলাকার একটি ফাঁকা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে বিচারালয় স্থাপন করে এবং একটি বটগাছের নীচে তৈরি করা হয় ফাঁসির মঞ্চ। ১৮১৫-‘১৬ সালে (মতান্তরে, ১৮১২) এই ফাঁসির মঞ্চেই গড়বেতা ও চন্দ্রকোনা এলাকার “নায়েক বিদ্রোহ” (বা, পাইক বিদ্রোহ) এর নেতা যুগল, কিশোর, সুবল, রাজেন, হাবল, ফাগু প্রমুখ ১৪ জনকে (বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী প্রাপ্ত তথ্য) ফাঁসি দেওয়া হয়! সেই “নির্মম ইতিহাস”ও যাতে জনসমক্ষে পরিস্ফুট হয়, নবীন প্রজন্ম যাতে জানতে পারে আদিম জনজাতিদের আন্দোলনের কাহিনী, সেজন্যই “ফাঁসিডাঙা” কে গড়ে তোলা হয়েছে এক ঐতিহাসিক পর্যটনস্থল রূপে। শুক্রবার সন্ধ্যায় যেটির উদ্বোধন করলেন জেলাশাসক ডঃ রশ্মি কমল।

thebengalpost.net
ঐতিহাসিক ফাঁসিডাঙা :