মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৭ জুলাই: “গোপাল বড় সুবোধ। রাখাল তেমন নয়। একথা আমরা সবাই পড়েছি। কিন্তু, আমরা অনেকেই জানি না, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁর বর্ণপরিচয়ের প্রথম দিককার সংস্করণে গোপাল আর সুবোধের পদবিও উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সরকারদের একটি ছেলে আছে, তার নাম রাখাল…ঘোষালদের গোপাল যেমন সুবোধ, রাখাল তেমন নয়।’ এমনকি গোপাল ও রাখালের এই কাহিনী প্রথমে ‘দ্বিতীয় ভাগ’-এ ছিল। পরে তা উনি প্রথম ভাগে নিয়ে আসেন। সেই সময়ই ‘পদবি’ পরিহার করেন। আবার, ভুবনের গল্প (দ্বিতীয় ভাগের) প্রথম আমরা পেলাম ৬২তম সংস্করণে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবদ্দশায় ‘বর্ণপরিচয়’ ১ম ভাগের ১৫২টি সংস্করণ এবং ২য় ভাগের ১৪০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি সংস্করণে তিনি এমনই নানা পরিবর্তন এনেছেন, গ্রহণ-বর্জন করেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় প্রকাশিত একটিও মূল সংস্করণ এই মুহূর্তে ভারতের কোথাও নেই। এই মুহূর্তে বলাটা ভুল হবে, ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রয়াণের পর থেকেই নেই!” কথাগুলি বলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেদিনীপুরেরই ‘ভূমিপুত্র’, শিক্ষক ও গবেষক অশোক পাল। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত ‘বর্ণপরিচয়’ এর আসল ও দুষ্প্রাপ্য সংস্করণের বেশ কিছু মূল পাঠ ও পাঠান্তর প্রকাশ্যে এলো ঈশ্বর-প্রয়াণের ১৩৩ বছর পর! খুকুড়দহ আইসিএম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক (বাংলা বিষয়ের) তথা লেখক ও গবেষক অশোক পাল সংকলিত ও সম্পাদিত “বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ, কয়েকটি মূল পাঠ ও পাঠান্তর” প্রকাশিত হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামাঙ্কিত মেদিনীপুরের (অবিভক্ত মেদিনীপুরের) গর্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়’ (Vidyasagar University)-র নিজস্ব প্রকাশনা বিভাগ থেকে।

thebengalpost.net
অশোক পাল সংকলিত ও সম্পাদিত বই হাতে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য:

thebengalpost.net
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বই:

সম্প্রতি, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে আয়োজিত একটি সাংবাদিক বৈঠকে উপাচার্য অধ্যাপক সুশান্ত কুমার চক্রবর্তী বলেন, “১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মৃত্যুর পর থেকে আর বর্ণপরিচয়ের আসল বা মূল সংস্করণ পাওয়া যায়নি। পরবর্তীকালে তাঁর ছেলে নারায়ণ চন্দ্র বিদ্যারত্নের (নারায়ণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের) সহায়তায় একটি রিসিভার বা নকল সংস্করণ অবলম্বনে ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশিত হতে থাকে। আসল সংস্করণ থেকে যায় লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। পশ্চিম মেদিনীপুরের লেখক, গবেষক তথা খুকুড়দহ আইসিএম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন (বাংলা বিষয়ের) শিক্ষক অশোক পালের উদ্যোগে সেই ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে আসল সংস্করণের পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়। শ্রী অশোক পাল ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগের ১১তম, ৬১তম, ৬২তম এবং দ্বিতীয় ভাগের ৮ম, ১৩তম, ১৭তম, ৬১তম ও ৬২তম সংস্করণ অবলম্বনে তাঁর “বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ, কয়েকটি মূল পাঠ ও পাঠান্তর” সংকলিত ও সম্পাদিত করেছেন। আর এই গ্রন্থ প্রকাশ করার সুযোগ পেয়ে আমরা (বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ) গর্বিত, আপ্লুত ও আহ্লাদিত। এর আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’-র উপর এরকম সমৃদ্ধ গ্রন্থ কখনও প্রকাশিত হয়নি।”

thebengalpost.net
অশোক পাল:

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক তথা নবজাগরণের ‘অগ্রদূত’ ও বাংলা গদ্যের ‘আদর্শ শিল্পী’ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষা শিক্ষার স্বার্থে ‘বর্ণপরিচয়’ (১ম ও ২য় ভাগ) রচনা করেছিলেন ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর জীবদ্দশায় ‘বর্ণপরিচয়’-র প্রথম ভাগের ১৫২টি সংস্করণ এবং দ্বিতীয় ভাগের ১৪০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কিন্তু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর (১৮৯১)-র পর সেই সংস্করণগুলির একটিও মেলেনি গোটা দেশে! এদিকে, তাঁর (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের) মৃত্যুর পর তাঁর ‘অবিমৃষ্যকারী’ পুত্র নারায়ণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিজস্ব লাইব্রেরি ‘বন্দক’ দিয়ে দেন! পরবর্তী সময়ে তা নিলামে ওঠে। কোর্ট থেকে ‘রিসিভার’ বসানো হয়। উঠে যায় স্বত্বাধিকার বা কপি রাইটও। ফলে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ (১৩০৩ বঙ্গাব্দে) থেকে (দেব সাহিত্য কুটিরের মাধ্যমে) ‘বর্ণপরিচয়’-র যে সংস্করণ প্রকাশিত হতে থাকে, তা আসলে ‘আসল’ বর্ণপরিচয়ের আদলে রচিত ‘রিসিভার’ বা নকল সংস্করণ। শুধু তাই নয়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পুত্র নারায়ণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারা ‘সংশোধিত ও পরিবর্ধিত’ সংস্করণ মাত্র! এমনটাই জানান বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান (HOD) তথা প্রতিথযশা লেখক ও অধ্যাপক ড. লায়েক আলি খান। তিনিই অশোক পাল সংকলিত ও সম্পাদিত বর্ণপরিচয়ের ‘মুখবন্ধ’ রচনা করেছেন। অধ্যাপক লায়েক আলি খান ছাড়াও, বিখ্যাত গবেষক অশোক উপাধ্যায় এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকার করেছেন শ্রী পাল।

thebengalpost.net
বইয়ের কিছু অংশ:

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার দাসপুর থানার অধীন রসিকগঞ্জের বাসিন্দা অশোক পাল এ প্রসঙ্গেই স্মরণ করিয়ে দেন, “সেই ১৯৩৯ সালে ‘ভাষাচার্য’ ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত (১৯৫৫) ‘বর্ণপরিচয়’ (১ম ও ২য় ভাগ)-র জীবদ্দশায় (১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ অবধি) প্রকাশিত ‘বর্ণপরিচয়’-র একটি সংস্করণও ভারতবর্ষে নেই! এমনকি, ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত ‘বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী’-তে বর্ণপরিচয়ের যে সংস্করণ (দ্বিষষ্টিতম বা ৬২-তম) মুদ্রিত হয়েছিল, সেটিও তাঁরা অনেক কষ্ট করে এবং কিছুটা বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই সংকলিত করেছিলেন মাত্র।” মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র তথা শিক্ষক ও গবেষক বছর দুয়েক আগে তাঁর লন্ডন নিবাসী একমাত্র ছেলে আবীর পালের সৌজন্যে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত বর্ণপরিচয়ের আসল ও দুষ্প্রাপ্য বেশ কয়েকটি সংস্করণের হদিশ পান। আইটি সেক্টরে কর্মরত ছেলে আবীর ও তাঁর এক অধ্যাপক বন্ধুর সহায়তায় সেই সংস্করণগুলির ‘প্রত্যয়িত’ অংশ তিনি হাতে পান। আর তারপরই বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্য নিয়ে তিনি প্রকাশ করেন “বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ, কয়েকটি মূল পাঠ ও পাঠান্তর”। বইটি খুব শীঘ্রই বাণিজ্যিক ভাবে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সুশান্ত কুমার চক্রবর্তী। একইসঙ্গে, ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ‘দুষ্প্রাপ্য’ সংস্করণ অবলম্বনে সম্পূর্ণ ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশের বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।

thebengalpost.net
সংকলিত অংশ:

thebengalpost.net
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত ‘বর্ণপরিচয়’-র একটি আসল সংস্করণ (অশোক পাল সংকলিত ও সম্পাদিত বই থেকে):