দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৬ আগস্ট: পশ্চিম মেদিনীপুরের সরকার পোষিত এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে পড়ুয়াদের নিজেদের ব্যাঙ্ক, হাসপাতাল, অডিটোরিয়াম। শিশুদের জন্য আছে স্মার্ট ক্লাসরুমও। শুধু কি তাই! এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের হাতেই তৈরি করে ‘শিখন শিক্ষণ উপকরণ’ (TLM)। সেই শিক্ষা উপকরণ একদিকে যেমন পড়ুয়াদের হাতে কলমে পাঠ গ্রহণের কাজে লাগে, ঠিক তেমনই এই সৃজনশীলতার জন্য কয়েকমাস আগে সমগ্র শিক্ষা মিশন আয়োজিত একটি প্রতিযোগিতাতেও তারা জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করতে পেরেছে। অতি সম্প্রতি জেলা প্রশাসন ও জেলা প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাল্যবিবাহ’ প্রতিরোধের বার্তাবহ শর্ট ফিল্ম প্রতিযোগিতাতেও খড়্গপুর গ্রামীণের হিজলি সংলগ্ন এই কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রথম স্থান অধিকার করেছে। আর সেই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা (টিচার ইন-চার্জ) তনুশ্রী দাস-ই আগামী ৫ সেপ্টেম্বর (শিক্ষক দিবস) ‘জাতীয় শিক্ষক পুরস্কার’-এ ভূষিত হতে চলেছেন। এর আগে (২০২০ সালে), রাজ্য সরকারের ‘শিক্ষারত্ন’ পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।

thebengalpost.net
ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দিদিমণি:

thebengalpost.net
বিজ্ঞাপন (Advertisement):

কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের তরফে চলতি বছর শিক্ষক দিবসে (৫ সেপ্টেম্বর) সারা দেশের ৪৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার হাতে তুলে দেওয়া হবে ‘জাতীয় শিক্ষক পুরস্কার’ (National Teachers’ Award 2025)। আজ, সোমবার (২৫ আগস্ট) প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, এই ৪৫ জনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মাত্র দু’জন শিক্ষক (বা, শিক্ষিকা) আছেন। তাঁদের মধ্যেই একজন খড়্গপুর গ্রামীণের হিজলি সংলগ্ন প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা (টিআইসি) তনুশ্রী দাস। অপরজন কলকাতার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল (দিল্লি পাবলিক স্কুল)-এর শিক্ষিকা মধুরিমা আচার্য। সেই হিসেবে বাংলা মিডিয়ামের একমাত্র শিক্ষক হিসেবে এই পুরস্কার পাচ্ছেন খড়্গপুরের তনুশ্রী দাস। স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বসিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন থেকে জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদও। সোমবার দুপুর নাগাদ এই খবর পৌঁছনোর পর থেকেই শুভেচ্ছার বন্যায় ভেসে যাচ্ছেন শিক্ষিকা তনুশ্রী দাস।

thebengalpost.net
চেয়ারম্যানের সাথে স্কুলের দিদিমণিরা:

২০২০ সালে রাজ্য সরকারের ‘শিক্ষারত্ন’ পুরস্কার পাওয়ার পর, অর্থমূল্যের ২৫ হাজার টাকাই নিজের স্কুলের উন্নয়নকল্পে তুলে দিয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা তনুশ্রী দাস। অগামী ৫ সেপ্টেম্বর দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে তাঁর হাতে রৌপ্য পদক (সিলভার মেডেল) এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে দেবেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। এই অর্থ নিয়ে নতুন কিছু ভাবনা? তনুশ্রী বলেন, “মেডেলখানি আমার হলেও, এই অর্থে আমার একার কোনও অধিকার নেই। এই অর্থ যতখানি আমার, ঠিক ততটাই আমার সহকর্মী সহ পড়ুয়া ও অভিভাবকদের। তাই স্কুলের জন্যই এই ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করব।” ২০২২ সালে কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সরকারের স্বচ্ছ বিদ্যালয় পুরস্কার সম্মানও পেয়েছে। ২০২৩ সালে রাজ্য সরকারের নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কারও পায় এই স্কুল। ১৯৯৯ সাল থেকে শিক্ষকতা করলেও ২০১৬ সালে কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তনুশ্রী দাস। দীর্ঘ এই শিক্ষকতা জীবনে শুধু স্কুল নয়, তিনি বদলে দিয়েছেন স্কুলের আশেপাশের পরিবেশও। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই এলাকার ছাত্রছাত্রীরা এখন স্কুলের কাঁচের আলমারিতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা লক্ষ্মীর ভাঁড়ে প্রতিদিন ১টাকা, ২টাকা, ৫টাকা করে জমায়। সঞ্জনা, রুবিনা, সৌমি, আফরিন, মানস, সাইনাদের সেটাই ‘চিলড্রেন্স ব্যাঙ্ক’। পড়ুয়াদের মনের কথা শোনার জন্য স্কুলে আছে ‘কানে কানে বলো’ বক্স। আছে স্বাবলম্বী কক্ষ। হঠাৎ কোন পড়ুয়া অসুস্থ হয়ে পড়লে, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য আছে শুশ্রূষা কক্ষ। এছাড়াও, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আছে কিচেন গার্ডেন, ভেষজ উদ্যান সহ আরও কত কি! বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমগুলিও অভিনব আর শিখন শিক্ষণ উপকরণে ঠাসা। ফলে সহজেই শিখতে পারে ছাত্রছাত্রীরা। পড়া মনে রাখতে পারে দীর্ঘদিন। সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে এমনই ‘সর্বাঙ্গসুন্দর’ এক স্কুল যিনি গড়ে তুলেছেন, তিনিই ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা তনুশ্রী দাস। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষকতা জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারে ভূষিত হতে চলেছেন তিনি। নিজের সম্মান বা পুরস্কার সহকর্মী, পড়ুয়া ও অভিভাবকদের সাথেই ‘ভাগ’ করে নিতে চান তনুশ্রী ম্যাডাম। সেইসঙ্গেই তিনি মনে করেন, “আমার জীবনের সবথেকে বড় প্রাপ্তি অভিভাবকদের আস্থা অর্জন। আর অবশ্যই সহকর্মীদের সহযোগিতা, প্রাক্তনীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং বর্তমান পড়ুয়াদের অগ্রগতি। এসব নিয়েই আগামীদিনও এগিয়ে যেতে চাই।”

thebengalpost.net
ছাত্রছাত্রীদের চিলড্রেন্স ব্যাঙ্ক:

thebengalpost.net
ভাঁড় হাতে পড়ুয়ারা: