দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৫ জানুয়ারি: রীতি, ঐতিহ্য ও পরম্পরা মেনে জঙ্গলমহল জুড়ে অনুষ্ঠিত হলো জঙ্গলের দেবী ‘বন দেবী’র পুজো। কোথাও বা এর নাম কুদ্রা বুড়ি, কোথাও বামুন বুড়ি, আবার কোথাও বুড়ি সিনি কিংবা স্থান বিশেষে অন্য কোনো নাম। প্রাচীনকালে প্রকৃতি নির্ভর সমাজে জঙ্গলের এই দেবীর কাছে নানা মানত করা হতো। বিশেষত, জঙ্গলে কোন পালিত পশু হারিয়ে গেলে বা ভালো ফসলের আশায় দেবীর কাছে মানত করা হতো। আর, পৌষ সংক্রান্তির পরের দিন অর্থাৎ ১ লা মাঘ দেবীর কাছে ‘নবান্ন’ উৎসর্গ করে এই পুজোয় মেতে উঠতেন কৃষিভিত্তিক সমাজের মানুষজন। মূলত অনার্যদের দেবী বা লৌকিক দেবী হলেও, তা কৃষিনির্ভর বাঙালি সংস্কৃতিরই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে! শনিবার (১৫ জানুয়ারি) জঙ্গলমহল পশ্চিম মেদিনীপুরের মেদিনীপুর শহর সংলগ্ন মুড়াকাটা (মেদিনীপুর সদর ব্লকের গুড়গুড়িপাল থানার অন্তর্গত) এলাকায় উৎসাহ ও আনন্দের সঙ্গে বনের দেবী ‘কুদ্রা বুড়ি’র পুজো অনুষ্ঠিত হলো। শুধু গ্রাম নয়, শহর থেকেও ভক্তবৃন্দ মানত পরিশোধ করতে বা পুজো দিতে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ‘নবান্ন’ উৎসর্গ করে পুজো দেওয়া হল। তারপর ‘নবান্ন’ এর প্রসাদ গ্রহণ করলেন ভক্তরা। মূলত, মহিলাদের সমাগমই বেশি হয়েছে। তবে, উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা গেছে, কোভিড ভীতি দূরে সরিয়ে বা মাস্কের মতো ‘আধুনিক’ পরিধানটি ব্যবহার না করেই, লৌকিক দেবী পূজা অনুষ্ঠানে মেতে উঠেছেন মহিলা ভক্তবৃন্দরা! তাঁদের মতে, “এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। তাই এখানে মাস্ক পরে না এলেও, কোভিড হবেনা!” তবে হ্যাঁ, উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নেননি। তাই, শুধু পুজোই হয়েছে, এবার আর মেলা বসেনি।

thebengalpost.net
বনদেবীর পুজো উপলক্ষে :

thebengalpost.net
নবান্ন চেপেছে হাঁড়িতে :

একদিকে, জঙ্গলের বা অরণ্যের দেবতা ‘বন দেবী’; অন্যদিকে, গ্রামের দেবতা ‘গরাম’। লৌকিক সংস্কৃতিরই অঙ্গ হিসেবে মনে করা হয়, জঙ্গলের কোন বিপদ থেকে রক্ষা করেন বন দেবী (ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন নাম), আর, বিপদের হাত থেকে গ্রামকে রক্ষা করেন ‘গরাম’ দেবতা। তাই তিনি গ্রাম রক্ষার দেবতা। কুড়মি ও আদিবাসী জনজাতির কাছে ১ লা মাঘ বছরের নতুন দিন। এঁদের ভাষায় ‘আইখ্যান যাত্রা’। এই দিন গ্রামের সীমান্তে তাঁরা গরাম পুজো করে থাকেন। প্রতি গ্রামের সীমান্তে প্রাচীন বৃক্ষের নিচে পোড়ামাটির হাতি, ঘোড়ার মূর্তি পুজো করা হয়। বলি প্রথাও চালু আছে। গরাম দেবতা প্রাচীন গ্রাম্য ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। প্রাচীন কালে সালিশিতে মীমাংসা না হলে, এই দেবতার মাথায় হাত রেখে উভয় পক্ষকে সত্য পাঠ করতে বলা হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই দেবতার নাম শুনলেই অপরাধী দোষ কবুল করে নিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ দেশের বিচার ব্যবস্থায় আদালতে গীতা বা কোরাণ ছুঁয়ে সত্য পাঠ এই নীতিরই অনুকরণ। গ্রামে অকাল মৃত্যু বা বসন্ত রোগ দেখা দিলে ওই গ্রামে পুজো বন্ধ থাকে। ১ লা মাঘ শুভ দিন হিসেবে ধরা হয়। বিভিন্ন সংস্কৃতির আগ্রাসনও তা বিনষ্ট করতে পারেনি। আদিম জনজাতির কৃষি সভ্যতার এই পরম্পরা কুড়মি জনজাতির সংস্কৃতির হাত ধরে, স্বমহিমায় গরাম পুজো পালিত হচ্ছে শালবনীর ধান্যশোলে। আর এক বিশেষজ্ঞ ড. ক্ষিতিশচন্দ্র মাহাতর মতে, আদিম জনজাতি জঙ্গল জীবন থেকে গ্রাম্য সভ্যতা গড়ে তোলে, তাঁরাই গ্রাম রক্ষার দেবতা হিসেবে গরাম পুজো পালন করে আসছেন।‌ এই পুজো আচারের মাধ্যমে শেষ হয় টুসু-মকর পরব। একই সঙ্গে ১ লা মাঘ দিনটি কুড়মি ও মূলবাসী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির কাছে শুভ নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনী ব্লকের ধান্যশোল, পিড়রালোহা প্রভৃতি গ্রামে এদিন রীতি ও আচার মেনে এই পুজো অনুষ্ঠিত হলো।

thebengalpost.net
গরাম পুজো, ধান্যশোল :

thebengalpost.net
গ্রামের সীমান্তে গরামের পুজো ও বলি, পিড়রালোহা: