দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১ জুলাই: নালা-নর্দমার জল থেকে সংগৃহীত হয়েছিল নমুনা। সেই নমুনা থেকেই কলেজের মাইক্রোবায়োলজি গবেষণাগারে ব্যাকটেরিওফাজ (Bacteriophage)- এর একটি নতুন প্রজাতি চিহ্নিত করা হয়েছিল ২০২৩ সালে। আর সেই ব্যাকটেরিওফাজ-ই চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে খুলে দিতে পারে নতুন দিগন্ত! মেদিনীপুর শহরের উপকন্ঠে ভাদুতলাতে অবস্থিত মেদিনীপুর সিটি কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক তথা বিজ্ঞানী কুন্তল ঘোষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০২৩ সালেই আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘ভাইরোলজি’ (Virology)-তে স্থান লাভ করেছিল এই গবেষণা। এই গবেষণাকর্মে ড. ঘোষের মূল সহযোগী হিসেবে ছিলেন তাঁর অধীনে গবেষণারত ছাত্রী স্মিতা ঘোষ। তাঁদের দ্বারা চিহ্নিত এই ব্যাকটেরিওফাজটির নামকরণ করা হয়েছিল AHPMCC7।

এরপর থেকে টানা প্রায় দু’বছর ধরে মেদিনীপুর সিটি কলেজের ওই গবেষকদল ব্যাকটেরিওফাজটি নিয়ে নানা গবেষণা চালান। তাতেই ধরা পড়ে, ব্যাকটেরিওফাজটি মাল্টি ড্রাগ প্রতিরোধী ‘অ্যারোমোনাস হাইড্রোফিলা’ নামক ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে পারে। অন্যদিকে, ‘অ্যারোমোনাস হাইড্রোফিলা’ (Aeromonas hydrophila) নামক এই ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া চিংড়ির শরীরে লিটোপেনিয়াস ভেনামি রোগ সৃষ্টি করে। চিংড়ির ভেড়িতে চিংড়ির অত্যধিক হারে মৃত্যুর জন্যও এই ব্যাকটেরিয়া দায়ী। নতুন আবিষ্কৃত এই ব্যাকটেরিওফাজের প্রয়োগে চিংড়ির মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে জানান মেদিনীপুর সিটি কলেজের গবেষক তথা বিজ্ঞানীরা। এজন্য চিংড়ির শরীরে কোন ক্ষতিকারক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের প্রয়োজন নেই বলেও জানান অধ্যাপক-বিজ্ঞানী কুন্তল ঘোষ। এর ফলে চিংড়ি চাষ ও ব্যবসায় এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। ড. ঘোষ বলেন, “অ্যারোমোনাস হাইড্রোফিলা নামক ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে চিংড়িকে বাঁচাতে নানা অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হয়। এর ফলে অনেক সময় বিদেশে চিংড়ি রপ্তানিতে সমস্যা হয়। বেশ কিছু দেশ এই অ্যান্টিবায়োটিক থাকা চিংড়ি গ্রহণ করে না। কিন্তু, আমাদের আবিষ্কৃত নতুন এই ব্যাকটেরিওফাজ জলে ফেলে দিলে তা প্রাকৃতিক উপায়েই ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে পারে।”
মেদিনীপুর সিটি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল তথা মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কুন্তল ঘোষ এও বলেন, “সম্পূর্ণ জিনোম সিকুয়েন্স (WGS) বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, এই ব্যাকটেরিওফাজ (AHPMCC7) আফুনাভাইরাস (Ahphunavirus) গণের একটি নতুন প্রজাতি। চলতি বছরই (২০২৫ সালে) ভাইরাসের শ্রেণীবিন্যাস সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কমিটি (ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ট্যাক্সোনমি অফ ভাইরাসেস বা ICTV) আমাদের (মাইক্রোবায়োলজি) গবেষণাগারে প্রাপ্ত ভাইরাসের এই প্রজাতিটিকে ‘নতুন প্রজাতি’ হিসেবে মান্যতা দিয়েছে এবং তাঁদের ডেটাবেসে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।” বলাই বাহুল্য, আন্তর্জাতিক এই সংস্থাই আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন ভাইরাসের শ্রেণীবিন্যাস এবং নামকরণের অনুমোদন প্রদান করে। গত কয়েকবছর ধরে চলা গবেষণালব্ধ কর্মটি মেদিনীপুর সিটি কলেজের নিজস্ব অর্থানুকূল্যে সংগঠিত হয়েছে। এই গবেষণাকর্মে বিজ্ঞানী ড. কুন্তল ঘোষ এবং তাঁর গবেষক ছাত্রী স্মিতা ঘোষের উদ্দেশ্যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন মেদিনীপুর সিটি কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক সুদীপ্ত চক্রবর্তী এবং প্রতিষ্ঠানের নিউট্রিশন (পুষ্টিবিজ্ঞান) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপিকা শ্রাবণী প্রধানও। আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিষ্ঠানের খ্যাতনামা অধ্যাপকের এই সাফল্যে স্বভাবতই খুশি অধ্যাপক থেকে পড়ুয়া সকলেই। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত এই বেসরকারি মহাবিদ্যালয়ের কর্ণধার অধ্যাপক প্রদীপ ঘোষ বলেন “আমাদের মহাবিদ্যালয়ের গবেষণাগারে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সত্যিই সাফল্যের। এই ধরনের ব্যাকটেরিওফাজ চিংড়ি চাষে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে সক্ষম বলেই আমরা মনে করছি।”