History

Karnagarh: শালবনীতে শিরোমণি’র গড় পরিদর্শনে রাজ্যের প্রতিনিধি দল! ‘হেরিটেজ’ হওয়ার পথে এগোচ্ছে ঐতিহাসিক কর্ণগড়

মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২২ জানুয়ারি: পরাধীন ভারতবর্ষের প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী তথা মেদিনীপুরের রাণী শিরোমণি ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন দ্বিতীয় “চুয়াড় বিদ্রোহ” (১৭৯৮-‘৯৯) এর নেত্রী হিসেবে। তাঁর স্মৃতিধন্য অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনী ব্লকের কর্ণগড় এখন এক ঐতিহাসিক পর্যটনস্থল। জেলা ও ব্লক প্রশাসনের হাত ধরে সেখানে হয়েছে সৌন্দর্যায়ন। তবে, রাণী শিরোমণি’র কর্ণগড়ে ইতিহাস, সাহিত্য ও বীরগাথা হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। স্বয়ং, রাণী শিরোমণি ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক আন্দোলনের (চুয়াড় বিদ্রোহ) দ্বিতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই কর্ণগড় থেকেই সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল আনন্দপুর, নাড়াজোল, গড়বেতা প্রভৃতি এলাকায়। তাছাড়াও, রাণীর এই কর্ণগড় সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন, যেমন অধিষ্ঠাত্রী দেবী মহামায়ার মন্দিরে বসে কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য সাধনা করতেন। প্রচলিত রয়েছে, এখানে বসেই রামেশ্বর ‘শিবায়ন’ কাব্য রচনা করেছিলেন। রামেশ্বরের কাব্যে কর্ণগড়ের উল্লেখও রয়েছে, “যশোবন্ত সিংহ/ সর্বগুণযুত/ শ্রীযুত অজিত সিংহের তাত। মেদিনীপুরাধিপতি/ কর্ণগড়ে অবস্থিতি/ ভগবতী যাহার সাক্ষাৎ।” সেই ইতিহাস, ঐতিহ্য আর বীরগাথা-কে শুধু সৌন্দর্যায়নে ঢেকে না দিয়ে, তাকে সংরক্ষণ ও সম্মানিত করার প্রয়োজনেই এলাকাবাসী ও রাণী শিরোমণি ঐক্য মঞ্চ এই গড়টিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণার দাবি তুলেছেন দীর্ঘদিন ধরে। এবার, সেই কর্ণগড়েই সম্প্রতি (বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারি) ঘুরে গেছেন রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের একটি প্রতিনিধি দল, এমনটাই জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ওই প্রতিনিধি দল গড় ঘুরে দেখেছেন বলে জানা গেছে। এর আগে অবশ্য, এএসআই (ASI- Archeological Survey of India)- এর একটি দলও ঘুরে গেছেন কর্ণগড়। প্রসঙ্গত, হেরিটেজ জার্নি, অখিল ভারতীয় ক্ষত্রিয় সমাজ সহ বিভিন্ন সংগঠন তথা ‘রাণী শিরোমণি ঐক্য মঞ্চ’ ইতিহাস ও স্থাপত্যের সংরক্ষণ, সংস্কার ও পুনরুদ্ধারের আবেদন জানাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরেই।‌ প্রয়োজনে গড়ের বিভিন্ন এলাকা খনন ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের দিয়ে পরীক্ষা করার দাবিও করছেন তাঁরা। ড. অন্নপূর্ণা চট্টোপাধ্যায় সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক, অধ্যাপক ও সমাজকর্মীরা তাঁদের সমর্থন জানিয়েছেন। বেঙ্গল পোস্ট (The Bengal Post.Net) সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমও প্রথম থেকে তাঁদের দাবি সমর্থন করে তা জনমানসে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এছাড়াও, ‘ভালোবাসি কর্ণগড়’ নামে ফেসবুক পেজ থেকে সকলে মিলে একযোগে দাবি তুলে ধরা হচ্ছে। সর্বোপরি, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে দাবিপত্র পেশ, এএসআই এবং মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে আবেদন করার কাজও সম্পূর্ণ। এবার, রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদলের পরিদর্শনে আশায় বুক বেঁধেছেন ঐক্য মঞ্চের নিসর্গ নির্যাস মাহাত, তন্ময় সিংহ প্রমুখরা।

কর্ণগড়ে রাজ্যের প্রতিনিধি দল (ছবি- স্থানীয় সূত্রে প্রাপ্ত):

প্রসঙ্গত, জঙ্গল অধ্যুষিত রাঢ় বঙ্গের সাঁওতাল, ভূমিজ, লোধা প্রভৃতি ‘চুয়াড়’ (পরিশীলিত অর্থে আদিম, অন্ত্যজ, খেটে খাওয়া মানুষ) সম্প্রদায়ের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কর্ণগড়ের এই রাণী শিরোমণি লড়াই করেছিলেন এই কর্ণগড় থেকে। ইতিহাস বলছে, চুয়াড় বিদ্রোহের (১৭৬৯-১৭৯৯) শেষ লড়াইতে (১৭৯৯) রাণী’র ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে। আদিবাসী প্রজা বা কৃষকদের থেকে অন্যায় ভাবে রাজস্ব বা খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে তিনি এই কৃষকদের আর্থিকভাবে সাহায্যের মধ্য দিয়েই নয়, সশরীরেও পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। জগন্নাথ সিং, দুর্জন সিং’দের পর রানী শিরোমণিই চুয়াড় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে, ইংরেজরা শিরোমণিকে চুয়াড় বিদ্রোহের মূল নেত্রী ঘোষণা করে পরোয়ানা জারি করে। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল (সম্ভবত) ব্রিটিশ বাহিনী কর্ণগড়ে পৌঁছলে, গড় থেকে গোপন সুড়ঙ্গপথে মেদিনীপুরের আবাসগড় প্রাসাদে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে যান রাণী। তাঁকে বন্দি করে কলকাতায় নিয়ে যায়, ইংরেজরা। প্রাসাদ লুঠ করে ধ্বংস করে দেয় ইংরেজ সৈন্যরা। মুক্তি পাওয়ার পরে শিরোমণি আর কর্ণগড়ে ফিরে যাননি। মেদিনীপুরের আবাসগড়ের প্রাসাদে শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন তিনি। ১৮১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আবাসগড়েই তাঁর মৃত্যু হয় বলে ঐতিহাসিকদের মত। পারাং নদী পরিবেষ্টিত রানী শিরোমণি’র সেই গড় বা রাজপ্রাসাদ-কে কেন্দ্র করেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন এক ঐতিহাসিক পর্যটনস্থল গড়ে তুলেছে সম্প্রতি। তবে, সৌন্দর্যায়ন হলেও, এখনও ‘সংরক্ষণ’ করা হয়নি ঐতিহাসিক সেইসব জরাজীর্ণ মন্দির ও স্থাপত্যগুলিকে। বরং গড়ের আশেপাশে আরও দু’টি সুপ্রাচীন মন্দিরের সন্ধান পেয়েছেন ‘ভালোবাসি কর্ণগড়’ বা ‘হেরিটেজ জার্নি’র সদস্য নিসর্গ নির্যাস মাহাত সহ অন্যান্যরা। এই সমস্ত মন্দির বা স্থাপত্য সংরক্ষণ ও সংস্কারের দাবি জানানো সহ ‘হেরিটেজ’ ঘোষণার মূল দাবি নিসর্গদের তৈরি ঐক্য মঞ্চের। এছাড়াও, সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা ও সংরক্ষণ করার দাবি তো রয়েছেই। সেই লক্ষ্যেই, নিসর্গরা গড়ে তুলেছেন রাণী শিরোমণি ঐক্য মঞ্চ। যেখানে আছে ‘অখিল ভারতীয় ক্ষত্রিয় সমাজ’ সহ অন্যান্যরা। তাঁরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বিভিন্ন জায়গায় আবেদন জানিয়েছেন। তাঁদের সহযোগিতা করেছেন মেদিনীপুরে বিধায়ক জুন মালিয়া সহ অনেকেই। এবার, তাঁদের সেই দাবি ধীরে ধীরে পূরণ হতে চলেছে। সূত্রের খবর অনুযায়ী, এর আগে ASI (Archaeological Survey of India) বা ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের পক্ষ থেকেও পরিদর্শন হয়েছে। এবার, রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের একটি দলও পরিদর্শন করল। সবমিলিয়ে, ‘হেরিটেজ’ হওয়ার পথে এগোচ্ছে রাণী শিরোমণি’র স্মৃতিধন্য ঐতিহাসিক কর্ণগড়, তা বলাই যায়।

জরাজীর্ণ আরও একটি মন্দির গড়ের পাশেই (ছবি- নিসর্গ নির্যাস মাহাত) :

বিজ্ঞপ্তি :
News Desk

Recent Posts

Vidyasagar University: আবহাওয়ার নিখুঁত খবর জানতে ISRO-র সহযোগিতায় আকাশে যন্ত্র লাগানো বেলুন পাঠাল বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৩ জুন: রবিবার (২২ জুন) দুপুর ঠিক ২টো ১…

1 day ago

Midnapore: “১৯৭৮-এর পর এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেনি গড়বেতা!” আসরে NDRF-SDRF; প্লাবন পরিস্থিতি চন্দ্রকোনাতেও

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২০ জুন: ১৯৭৮ সালের পর এমন ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির…

4 days ago

Midnapore: মিয়াজাকি, ব্ল্যাকস্টোন থেকে আম্রপালি, হিমসাগর; মেদিনীপুরে জমজমাট ‘আম উৎসব’

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৮ জুন: ৩০ টাকা প্রতি কেজি থেকে ৩ লক্ষ…

6 days ago

Kharagpur: খড়্গপুরের কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ! মৃত্যু এক শ্রমিকের

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, খড়্গপুর, ১৭ জুন: গ্লিসারিন কারখানায় ওয়েল্ডিং- এর কাজ চলাকালীন ভয়াবহ বিস্ফোরণ!…

1 week ago

Midnapore: প্রায় দু’দশক পরে পশ্চিম মেদিনীপুরে শুরু হয়েছিল প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া; থমকে গেল আদালতের নির্দেশে

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৬ জুন: ২০০৮ এর পর ২০২৫। দীর্ঘ প্রায় দুই…

1 week ago

Elephant: হাতির পালকে তাক করে ছোঁড়া হচ্ছে একের পর এক জ্বলন্ত হুলা; নেটমাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে পড়তেই নিন্দার ঢল

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, খড়্গপুর, ১৩ জুন: হাতির পালকে তাক করে ছোঁড়া হচ্ছে একের পর…

2 weeks ago