দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, খড়্গপুর, ১২ জানুয়ারি: আড়াইটার সময় ছিল ফ্লাইট। কলকাতায় একটি মিটিং শেষ করে সবেমাত্র বিমানবন্দরের (কলকাতা বিমানবন্দরের) উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন আইআইটি খড়্গপুরের সাময়িক দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিরেক্টর (Additional Charge) অধ্যাপক অমিত পাত্র। সেই সময়ই আসে দুঃসংবাদটা! ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং -র তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র সাওন মালিকের দেহ উদ্ধার হয়েছে! তিনি নিজেও আইআইটি খড়্গপুরের (IIT Kharagpur) এই বিভাগেরই (ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) প্রাক্তনী এবং অধ্যাপক ছিলেন। সাওনকেও অত্যন্ত ভালো ছাত্র হিসেবেই চিনতেন। খবরটা পাওয়ার পরই তাই আইআইটি বারাণসী (IIT BHU/IIT Varanasi) যাওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন ওই (বারাণসী আইআইটি’র) আইআইটি’র স্থায়ী অধিকর্তা (Director) অধ্যাপক পাত্র। সোজা চলে আসেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ তাঁর গাড়ি পৌঁছে যায় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের মর্গের সামনে। সেখানেই ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে আসা হয় বছর ২১-র সাওনের মৃতদেহ। ময়নাতদন্তের শেষ না হওয়া অবধি মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের মর্গের সামনেই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আইআইটি খড়্গপুরের (IIT Kharagpur) প্রাক্তন ডেপুটি ডিরেক্টর তথা বর্তমান ডিরেক্টর (অ্যাডিশনাল চার্জ) অমিত পাত্র। মৃতদেহ সাওনের গ্রামের বাড়ির (পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার খুকুড়দহের) উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পরই মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেরোন আইআইটি খড়্গপুরের ডিরেক্টর। শেষ কবে এমনটা হয়েছে, মনে করতে পারছেন না কেউই!
ততক্ষণে অবশ্য মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মর্গে পৌঁছে যান পশ্চিম মেদনীপুর জেলা প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ আধিকারিকরা। ছিলেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) সন্দীপ টুডু, অতিরিক্ত জেলাশাসক (পঞ্চায়েত) মৌমিতা সাহা, জেলার তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক বরুণ মণ্ডল সহ পুলিশ ও প্রশাসনের একাধিক আধিকারিক। হবে নাই বা কেন! সাওনের বাবা স্বরূপ কুমার মালিক রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনের আপ্ত সহায়ক। দুপুর নাগাদ শোক সংবাদ নবান্নে পৌঁছনোর পর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেন। আইআইটি খড়্গপুরে পৌঁছন জেলা পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার। স্নিফার ডগ দিয়ে সাওনের রুম এবং হোস্টেলের আশেপাশে তল্লাশি চালানো হয়। যদিও, সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি বলেই পুলিশ সূত্রে খবর। এদিন শুধু জেলা প্রশাসনের আধিকারিকরা নন, মেধাবী ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ সহপাঠী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, সিনিয়র ছাত্র-ছাত্রীরাও পৌঁছন মেদিনীপুর মেডিক্যালে। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই হতবাক!
প্রসঙ্গত, আর পাঁচটা রবিবারের মতোই এদিনও একমাত্র ছেলের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন বাবা-মা। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ছেলের প্রিয় সব খাবার-দাবার। কিন্তু, সকাল ১১টা নাগাদ সাওনের রুমের সামনে গিয়ে বারবার ডাকাডাকি করার পরও ছেলের সাড়া না পেয়ে অবাক হয়ে যান স্বরূপ বাবু ও তাঁর স্ত্রী! এরপরই, দরজার পাশের একটি জানালায় ধাক্কা দিলে তাঁরা দেখেন মর্মান্তিক দৃশ্য! গামছায় ফাঁস লাগিয়ে ছেলে ঝুলছে জানালার রড থেকে! মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে তাঁদের। শনিবার রাতেও ছেলে ভালোভাবেই কথা বলেছে বাবা-মা’র সাথে। কেউ ঘুনাক্ষরেও কিছু টের পাননি। হঠাৎ কি এমন হল! আইআইটি কর্তৃপক্ষের তরফে খবর দেওয়ার পর, টাউন থানার পুলিশ দেহ উদ্ধার করে প্রথমে খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতাল এবং তারপর মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে পাঠায় ময়নাতদন্তের জন্য। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে আইআইটি খড়্গপুরের ডিরেক্টর (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক অমিত পাত্র বলেন, “এত ভালো ছেলে। CGPA নাইনের ওপরে। সকলের সঙ্গেই সুসম্পর্ক। শিক্ষকদের সকলের প্রিয়। অনেক শিক্ষকই প্রজেক্টের অফার দিয়েছিলেন। ভালো নাটক করত। কোথাও কোনও নেতিবাচক কিছু খুঁজে পাইনি আমরা। কিছুই বুঝতে পারছিনা! পুলিশ তদন্ত করবে। আমরা পূর্ণ সহযোগিতা করব।” তিনি এও বলেন, “অন্যান্য রবিবারের মতোই ওর বাবা-মা ছেলের পছন্দের খাবার-দাবার নিয়ে পৌঁছেছিলেন। তাঁরাই প্রথম দেখেন!” থ্রেট কালচারের প্রশ্নে, আইআইটি’র এই বাঙালি অধিকর্তার জবাব, “আইআইটি-তে মেডিক্যাল কলেজের মতো থ্রেট কালচারের বিষয় সেভাবে নেই।” সাওনের এক সিনিয়র বলেন, “খুব মেধাবী ছিল। আমাদের সকলের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল। কিছুই বুঝতে পারিনি আমরা! আর চাপ সেভাবে কিছু ছিল না।” একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান বাবা-মা কথা বলার মত পরিস্থিতিতে ছিলেন না। সাওনের এক কাকু (অমল মালিক) বলেন, “এই বছর পুজোতেও এসেছিল মেদিনীপুরের বাড়িতে। প্রতি বছরই আসত। খুব শান্ত ও নিরীহ ছেলে। ছোট থেকেই মেধাবী। ও কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না! ও এতটাই নরম মনের, এইভাবে আত্মহত্যার কথা ও ভাবতেও পারবেনা। নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যাপার আছে! আর প্রতিবছর আইআইটি-তে এই ধরনের ঘটনা ঘটে কি করে! কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু একটা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।” এদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ময়নাতদন্ত শেষে দেহ প্রথমে যায় সাওনের গ্রামের বাড়িতে অর্থাৎ পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর থানার খুকুড়দহের বাড়িতে। সঙ্গে যান অতিরিক্ত জেলাশাসক (পঞ্চায়েত) মৌমিতা সাহা, তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক বরুণ মণ্ডল প্রমুখ। রাত্রি ১০টা নাগাদ দাসপুরের খুকুড়দহ থেকে মেদিনীপুরের মেধাবী সন্তান সাওনের নিথর দেহ রওনা দেয় কলকাতার উদ্দেশ্যে।