দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, সৌমেন মন্ডল, ৯ আগস্ট: একবিংশ শতকের ‘গুপ্ত শত্রু’ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অমৃতলোকে পাড়ি দিলেন ঝাড়গ্রাম তথা জঙ্গলমহলের লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রবীণ গবেষক ড. সুব্রত কুমার মুখোপাধ্যায়। গত বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) প্রয়াত হন জঙ্গলমহলের ‘আত্মার আত্মীয়’ সুব্রত বাবু। ঝাড়গ্রাম তথা জঙ্গলমহলের নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক আত্মার সঙ্গে আজন্ম যে মানুষটির নিবিড় যোগাযোগ, তিনি ড. সুব্রত মুখোপাধ্যায়। জঙ্গলমহলের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে ঝাড়গ্রামের ভূমিপুত্র সুব্রত বাবু’র পদচিহ্ন পড়েনি। ঝাড়গ্রাম সহ বিভিন্ন জেলার জনগোষ্ঠীর নিকটজন তিনি। তাদের সুখ দুঃখের সাথী হয়ে ছিলেন তিনি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন শীতলা মঙ্গলের মূল গায়ক হিসেবে।
জঙ্গলমহলের জনগোষ্ঠীর লৌকিক দেবী শীতলা ও মনসার পালাগান দিয়েই লোক সংস্কৃতির জগতে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। ‘শীতলা’ বিষয়ে মূল্যবান গবেষণা নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। পরবর্তী কালে জঙ্গলমহলের নানা জনজাতির সমাজ ধর্ম সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার কাজ করেছেন। শুধু গবেষণাই নয়, জনজাতিদের লুপ্ত প্রায় সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। লোকনৃত্য, লোকগীতি, লোকবাদ্য সহ হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে সর্বসমক্ষে নিয়ে আসার পেছনে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদান অপরিসীম। লোধা শবর সম্প্রদায়ের লুপ্ত প্রায় চাঙ গান ও চাঙ নৃত্যকে পুনরায় সংস্কৃতির মঞ্চে হাজির করেছিলেন নিজের উদ্যোগে। পরবর্তীকালে, শিল্পীরা সরকারি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে জীবিকা অর্জনের পথ খুঁজে পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত প্রান্তে কোথায় কি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান রয়েছে এবং কোন সময় কি লোক সংস্কৃতির প্রচলন রয়েছে তা জানার জন্য বয়সের ভারকে উপেক্ষা করে ছুটে গিয়েছেন। তাঁর লেখা অজস্র গবেষণা ধর্মী বইয়ে মূল্যবাণ তথ্য গুলো লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁর এই সমস্ত বইগুলি হল- (১) “ঝাড়গ্রাম জেলা প্রত্ন – পরিক্রমা” (২) “ঝাড়গ্রামের লোকসম্পদ ও সংস্কৃতি” (৩) “জঙ্গলমহলে লোধা ও বিপন্ন বিনোদন” (৪) “CHANG A dying Folk – Art of the Lodha Tribes of Subarnarekha Basin” (৫) Cult of Goddess Sitala in Bengal (An enquiry into Folk culture) (৬) ” সীমান্ত বাংলার বিলুপ্ত লোকক্রীড়া “, (৭) “জঙ্গলমহলের কুঠার মানুষ” (৮) “পালা পর্বনের আঙিনায় বাংলার শবর”, ইত্যাদি গ্রন্থগুলি রচনা করেছেন। তাঁর লেখা বইগুলি ঝাড়গ্রাম তথা জঙ্গলমহলের লোকসংস্কৃতি চর্চার জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর অজস্র তথ্য সমৃদ্ধ লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকা তাঁকে “জঙ্গলমহলের সিধু জেঠু” নামে আখ্যায়িত করেছে। সুব্রত বাবু বেঁচে থাকবেন তাঁর অসংখ্য গুনমুগ্ধ মানুষদের হৃদয়ে, তাঁর সৃষ্টির মহিমায়!