দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, সমীরণ ঘোষ, ৮ মার্চ:চেয়ারম্যান করা তো দূরের কথা, বিধানসভাতে ঢুকতেই বাধা দেওয়া হল তাঁকে! সোমবার (৭ মার্চ) বিধানসভা অধিবেশনের প্রথম দিনে এমনই মারাত্মক অভিযোগ করে খড়্গপুর সদরের বিজেপি বিধায়ক হিরন্ময় চট্টোপাধ্যায় (হিরণ) বললেন, “ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা! আমি বিধায়ক, আমাকেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।” হিরণকে ট্যাগ করে গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়ার এই ভিডিও টুইট করছেন বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। সেখানেই হিরণকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, অধিবেশনে যোগ দেওয়ার পর তিনি জল খেতে বাইরে গিয়েছিলেন। তার পর ফের অধিবেশনের ঢোকার আগেই তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়! এরপরই, সেই তালা লাগিয়ে দেওয়ার ভিডিও সহ হিরণের বক্তব্য বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র টুইট করেন। এদিকে, হিরণের চেয়ারম্যান (খড়্গপুর পৌরসভাতে) হওয়ার গল্প দু’দিন আগেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূলের মেদিনীপুর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা। বেঙ্গল পোস্ট-কে তিনি জানিয়েছিলেন, “ওসব মিডিয়ার গল্প। তৃণমূলের পুর বোর্ডে হিরণ কেন চেয়ারম্যান হতে যাবেন! তৃণমূলে অনেক যোগ্য লোক আছেন।” তবে, বেশকিছু মিডিয়া তাঁকে চেয়ারম্যান করা নিয়ে ‘নানা গল্প’ ফাঁদলেও হিরণ নিজে এতদিন চুপ ছিলেন। সোমবার কলকাতায় পা রাখার সাথে সাথেই তাঁকে এনিয়ে চেপে ধরে প্রথম সারির সমস্ত সংবাদমাধ্যম। সেখানেই জল্পনা উড়িয়ে হিরণ জানিয়েছেন, “পুরসভায় ২০টি ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। তাই ওরাই বোর্ড করবে এটাই স্বাভাবিক। আমি বিরোধী দলের বিধায়ক এবং বিরোধী দল বিজেপি’র প্রতীকেই কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছি। তাই, কোনও ভাবেই খড়গপুর চেয়ারম্যান হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।” তিনি এও জানিয়েছেন, “আমাকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি। কোনও কিছুই সত্য নয়।” তবে, সেই সমস্ত লেখালেখি যে তিনি উপভোগ করছিলেন, তাও জানিয়েছেন হিরণ।
উল্লেখ্য যে, ২ মার্চ ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যায়, খড়্গপুর পৌরসভার ৩৩ নং ওয়ার্ডে প্রবীণ তৃণমূল কংগ্রেস নেতা জহর পাল-কে মাত্র ১০৮ ভোটে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন বিজেপি প্রার্থী তথা বিধায়ক হিরন্ময় চট্টোপাধ্যায়। এরপর থেকেই হিরণ-কে নিয়ে কিছু মিডিয়া অহেতুক বাড়াবাড়ি করেছে ঠিকই, তবে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর থেকেই যেভাবে দিলীপ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে নেমেছে খড়্গপুরের হিরণ গোষ্ঠী; তাতে ওইসব মিডিয়াকে দোষ দিয়েও লাভ নেই! সর্বোপরি, মেদিনীপুরের সাংসদ দিলীপ ঘোষের সঙ্গে তাঁর সংসদ এলাকারই বিধায়ক তথা তাঁর একসময়ের গড় হিসেবে পরিচিত খড়্গপুর সদর বিধানসভার দলীয় জনপ্রতিনিধি হিরণের মুখ দেখাদেখিও প্রায় বন্ধ গত ৮-১০ মাসে। এছাড়াও, গত ৪ জানুয়ারি (২০২২) বিজেপির সমস্ত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছেড়েও বেরিয়ে আসেন হিরণ। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে নিয়ে জল্পনা বাড়ছিল! আর, সেই সমস্ত জল্পনা না উড়িয়ে, হিরণ বারবার প্রকাশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উন্নয়ন’ এর প্রশংসা করেছেন। এমনকি, খড়্গপুরের রেল, আইআইটি-কে তুলোধুনা করেছেন। পরোক্ষে কটাক্ষ করেছেন মেদিনীপুরের সাংসদ দিলীপ ঘোষ-কেও। তাই, তাঁর তৃণমূল-যোগ নিয়ে নিঃসন্দিগ্ধ ছিলনা খোদ বিজেপিও! ফলে, পুরভোটে তাঁকে ৩৩ নং ওয়ার্ডের টিকিট দেওয়া হলেও, বাকি ৩৪-টি ওয়ার্ডে প্রচারের মুখ করা হয়েছিল দিলীপ ঘোষ-কে। হিরণ-ও নিজের ওয়ার্ড ছেড়ে কোথাও প্রচারে যাননি! তারপর, হিরণ জিতেছেন। তিনি ছাড়া আরও ৫ জন বিজেপি প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। তবে, হিরণ তৃণমূলে যাচ্ছেন এবং তৃণমূলের তরফে তাঁকে চেয়ারম্যানও করা হতে পারে, এরকম একটা জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে। হিরণও হাবেভাবে সেটাকে তোল্লাই (প্রশ্রয়) দিয়ে আসছিলেন, তৃণমূলের মনোভাব বোঝার জন্য! এমনকি, পরোক্ষে চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশও করেছেন। বলাই বাহুল্য, হিরণের সেই সমস্ত ইচ্ছে বা বাসনা-কে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি তৃণমূলের তরফে। সম্প্রতি, ৫ মার্চ বেঙ্গল পোস্টের খবরে প্রকাশিত হয়েছিল, এমনিতেই শাসকদলের গোষ্ঠী কোন্দল রেল শহর খড়্গপুরের রাজনীতিতে; তার উপরে হিরণকে ‘ডেকে এনে’ সেই গোষ্ঠী কোন্দলের আগুনে নতুন করে ঘৃতাহুতি করতে চায়নি কোনো পক্ষই। সর্বোপরি, রেল শহরের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে আছেন জহর পাল, রবিশঙ্কর পান্ডে, দেবাশীষ চৌধুরী (মুনমুন)-রা। গত কয়েক বছরে উঠে এসেছেন প্রদীপ সরকার। তাছাড়াও, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন নতুন তৃণমূলে অপেক্ষাকৃত তরুণ জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা-ও দলের একনিষ্ঠ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কর্মীদের সামনে আনতে চাইছেন! সেখানে কোনোভাবেই জায়গা নেই হিরণের। আর, এখনই রাজ্য নেতৃত্ব-ও ‘দলবদলু’ নেতাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ! কারণ, তাদের ছাড়াই বিভিন্ন নির্বাচনে ভালো ফল করেছে তৃণমূল।
এই পরিস্থিতিতে, প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা প্রাক্তন পৌর প্রশাসক মণ্ডলীর চেয়ারপারসন এবং ৬ নং ওয়ার্ডের নব নির্বাচিত কাউন্সিলর প্রদীপ সরকার-ই চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন। তবে, বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে বেশকিছু দুর্নীতি, বিলাসবহুল জীবনযাপন ও স্বজনপোষণের অভিযোগ তুলতে শোনা গেছে তাঁর দলেরই বিরোধী গোষ্ঠীর নেতাকর্মীদের। বিশেষত, রবিশঙ্কর, দেবাশীষের মতো পুরানো নেতাদের সঙ্গে প্রদীপের বিশেষ বনিবনাও নেই! তা সত্বেও এগিয়ে প্রদীপ। কারণ, দেবাশীষ চৌধুরী এবং রবিশঙ্কর পান্ডে এবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি! তবে, তাঁদের দু’জনের স্ত্রী-ই ভোটে দাঁড়িয়ে (যথাক্রমে, ১৭ নং ওয়ার্ড ও ২৮ নং ওয়ার্ড) বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু, তাঁরা যে চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে টক্কর দিতে পারবেন না তা বলাই বাহুল্য। যদিও সূত্রের খবর অনুযায়ী, চেষ্টা জারি রেখেছেন তাঁরাও। অন্যদিকে, বর্ষীয়ান জহর পাল পরাজিত হয়েছেন। ফলে, তুলনামূলক ভাবে এগিয়ে আছেন প্রদীপ-ই। যদিও, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর হিসেবে আরও দু’টি নাম ভেসে বেড়াচ্ছে। ৭ নং ওয়ার্ডের দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর কল্যাণী ঘোষ এবং ৩৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা অভিজ্ঞ তৃণমূল নেতা অপূর্ব ঘোষ। শোনা যাচ্ছে, প্রদীপের বিকল্প হিসেবে এঁদের কথা ভাবছে দলের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীও। যদিও জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা জানিয়েছেন, “সিদ্ধান্ত নেবে রাজ্য নেতৃত্ব।” এদিকে, ২১ নং ওয়ার্ডের কঠিন লড়াইয়ে কংগ্রেস প্রার্থী জগদম্বা প্রসাদ গুপ্তা-কে ১০৫৫ ভোটে জিতে আসা তৃণমূলের তরুণী মহিলা কাউন্সিলর ডি. বাসন্তীও দলের সুনজরে আছেন বলে জানা গেছে। শিক্ষিতা এই তরুণী চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যানের দৌড়ে না থাকলেও, পৌরসভার কোনো একটি দপ্তর বা পরিষদের দায়িত্ব পেতে পারেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও, পৌরসভার কোনো একটি দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে ১৮ নং ওয়ার্ড থেকে বিশাল ব্যবধানে (২৮১৭) জয়ী কাউন্সিলর পূজা নাইডু-কেও।