দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১০ জুন: ভুবনেশ্বরে (AIIMS-এ) চিকিৎসা করাতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল। কে জানত কেন্দ্রীয় সরকারের হাসপাতালে বসে রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দফতরে চাকরি দেওয়ার ‘টোপ’ ফেলে বসে আছেন শহর মেদিনীপুরের এক ‘ঠগবাজ’! পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর ব্লকের আনন্দপুরের ‘সহজ-সরল’ দম্পতি সহজেই গিলেও ফেলেন ভদ্র-সভ্য চেহারার, মিষ্টভাষী কৌশিকের ‘চাকরির টোপ’। ১ লক্ষ টাকায় প্রায় ঘরের কাছে, কেশপুর গ্রামীণ হাসপাতালে চুক্তিভিত্তিক অফিস অ্যাটেন্ডেন্টের কাজ। সংসারে অভাব ছিল। তাই, স্ত্রী-র চাকরির জন্য রাজি হয়ে যান দীপক (নাম পরিবর্তিত)। এরপর, গত দু’তিন মাস ধরে অনলাইন (ফোন পে প্রভৃতির মাধ্যমে) এবং অফলাইন (হাতে-হাতে) মাধ্যমে ১ লক্ষ টাকা দেওয়া সম্পূর্ণ হলে, গত ২৯ মে (২০২৪) তাঁদের হাতে ‘নিয়োগপত্র’ (Appointment Letter) তুলে দেন জেলা শহর মেদিনীপুরের বিধাননগর এলাকার বাসিন্দা কৌশিক ঘোষ। আজ, সোমবার (১০ জুন) সকালে সেই নিয়োগপত্র সহ স্ত্রী-কে নিয়ে কেশপুর গ্রামীণ হাসপাতালে গিয়েছিলেন দীপক (নাম পরিবর্তিত)। বিষয়টি ‘গড়বড়’ বুঝতে পেরেই কেশপুর হাসপাতালের BMOH সহ স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের মেদিনীপুর শহরের জেলা স্বাস্থ্য ভবনে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আর সেখানে পৌঁছেই ওই দম্পতি বুঝতে পেরে যান তাঁরা ‘প্রতারিত’ হয়েছেন!
এদিকে, গত এক সপ্তাহে এই নিয়ে ৪ জন স্বাস্থ্য দফতরের ‘ভুয়ো’ নিয়োগপত্র নিয়ে এসে চাকরিতে যোগদান করতে চাওয়ার ঘটনায় নড়েচড়ে বসেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকারিক ডঃ সৌম্যশঙ্কর সারেঙ্গী সহ স্বাস্থ্য আধিকারিকরা। ওই দম্পতিকে আটক করে (বা, বসিয়ে রেখে) জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। খবর দেন কোতোয়ালী থানাতেও। পৌঁছন সাংবাদিকরাও। জানা যায়, গত কয়েক মাস আগে ভুবনেশ্বরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে কৌশিকের সঙ্গে আলাপ হয় পশ্চিম মেদিনীপুরের আনন্দপুরের ওই দম্পতির। ‘বিশ্বাস’ করে মেদিনীপুর শহরের বছর ৪৫-র ওই ব্যক্তিকে (কৌশিক ঘোষকে) বেশ কয়েক দফায় ১ লক্ষ টাকা পাঠান তাঁরা। অবশ্য কৌশিকের ছবি, ফোন পে নম্বর সহ টাকা পাঠানোর সমস্ত প্রমাণই নিজেদের কাছে গুছিয়ে রাখেন ওই দম্পতি। সবকিছু দেখেশুনে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকারিক ডঃ সারেঙ্গী বলেন, “গত এক সপ্তাহে এই নিয়ে চারজনের সঙ্গে একই ঘটনা ঘটল। সকলেই একই নম্বরে টাকা পাঠিয়েছেন। আমরা আগের তিনটি ঘটনায় FIR করেছি। এক্ষেত্রেও করব। পুলিশকে জানিয়েছি ইতিমধ্যে। এই র্যাকেট ধরা দরকার। সাধারণ মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। এতে স্বাস্থ্য দফতরেরও বদনাম হচ্ছে। আমরা চাইনা আর কেউ এইভাবে প্রতারিত হোক।”
কোতোয়ালী থানার তরফে ইতিমধ্যে ঘটনার তদন্ত শুরু করা হয়েছে। তদন্তে সমস্ত রকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন ওই দম্পতি। প্রতারিত মহিলার স্বামী বলেন, “আমি তেমন কিছু করি না। ভেবেছিলাম স্ত্রী এই চুক্তিভিত্তিক কাজটা যদি পায়, মেয়েটাকে (বছর পাঁচেকের কন্যা) মানুষ করতে পারব। ওই ব্যক্তির আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা শুনে আমরা বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। তবে, ওই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পাওয়ার পরই প্রথম সন্দেহ হয়। ওতে যে সইগুলো আছে, তা একটু অন্যরকম। এরপর আমরা যাচাই করার জন্য আজ (সোমবার) প্রথমে কেশপুর হাসপাতাল এবং পরে স্বাস্থ্য ভবনে আসি। বুঝতে পারি, যে ভয়টা পাচ্ছিলাম, তাই হয়েছে!” লজ্জায়, অপমানে, কষ্টে ভেঙে পড়েছেন তাঁর স্ত্রী। সোমবার বিকেলে কৌশিকের বিধাননগরের বাড়ি গিয়ে জানা যায়, কৌশিক আপাতত পলাতক! বাড়িতে বৃদ্ধা মা আছেন। বাবা কিছুদিন আগেই মারা গেছেন। প্রতিবেশীদের মধ্যে কয়েকজন বলেন, “বাবা ভালো চাকরি করতেন। শিক্ষিত ও ভদ্র পরিবার। শুধু কৌশিক-ই ছোটো থেকে লোক ঠকিয়ে বেড়ায়! এটাকেই বোধহয় পেশা বানিয়ে ফেলেছে।” কৌশিকের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন, মেদিনীপুর শহরে এমন সংখ্যা নেহাত কম নয় বলেই জানা গেল বিভিন্ন সূত্রে। একাধিকবার নাকি থানায় অভিযোগও হয়েছে। এক দম্পতি জানান, বছর দুয়েক আগে তাঁদের ভাইজাগ (চেন্নাই) ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে কয়েক হাজার টাকা আত্মসাৎ করে কৌশিক। এক প্রতিবেশী ‘সাহস’ করে বলেন, “শুনেছি, ছোটো বেলায় নিজের সাইকেল বিক্রি করে এসে বাবাকে বলেছিল, চুরি হয়ে গেছে!” আপাতত বিধাননগরের এই গুনধরের খোঁজে তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ।