দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম, ১ মার্চ: সব বিচারের ঊর্ধ্বে নাকি ঈশ্বরের বিচার! সাহিত্যে তাকেই হয়তো ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ (কাব্যিক বিচার বা ন্যায় বিচার) বলা হয়। আর ধর্মগ্রন্থে বলে- “কৃতকর্মের ফল ভোগ করা!” একসময় ‘আইন নিজেদের হাতে’ তুলে নিয়ে শত সহস্র বাবা-মা’র কোল যাঁরা খালি করেছিলেন, স্ত্রী-সন্তান-ভাই-বোনদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন প্রিয় জন বা আপনজনকে; আজ তাঁদেরও ‘প্রিয় জন’ বা ‘আপনজন’-দের আপাতত বিদায় জানিয়ে জেলে যেতে হচ্ছে সারা জীবনের জন্য (বা, বাকি জীবনের জন্য)। আদালতের বাইরে কেঁদে ভাসাচ্ছেন তাঁদের পরিবার-পরিজনেরা! আবার কাউকে জেলের ভেতরেই মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে হচ্ছে বা আগামীদিনেও তাই করতে হবে। ১৪ বছর আগে শিলদার ইএফআর ক্যাম্পে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে ২৪ জন জওয়ানকে নির্মম ভাবে হত্যা করে, অস্ত্রভাণ্ডার লুট করার ঘটনায় গত মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) যে ২৩ জন মাওবাদীকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন মেদিনীপুর আদালতের বিচারক সেলিম শাহী, বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ও বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) তাদের প্রত্যেককেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছেন তিনি। তালিকায় আছেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তনী তথা আইআইটি খড়্গপুরের (IIT Kharagpur) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-র মেধাবী ছাত্র অর্ণব দাম (মাও নেতা বিক্রম) থেকে অবিভক্ত মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ির কলেজ পড়ুয়া বুদ্ধেশ্বর মাহাতো-ও।

thebengalpost.net
২০১২ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর অর্ণব দাম (ছবি- সংগৃহীত):

উল্লেখ্য যে, নিজেদের ‘সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ’-কে পদদলিত করে অতি-বাম রাজনীতিতে নাম লেখানো অর্ণব, বুদ্ধেশ্বর-রা একসময়ে হয়ে উঠেছিলেন জঙ্গলমহলের ত্রাস! কলম ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন এ.কে 47 কিংবা ইনসাস রাইফেল। দেশ কিংবা মানুষের সেবায় নিয়োজিত জওয়ান থেকে ভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতিকদের তরতাজা-শরীর গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিতে হাত কাপেনি তাঁদের। তা সে শিলদার EFR ক্যাম্পে হামলাই হোক বা বিভিন্ন সময়ে জঙ্গলমহল জুড়ে চালানো একের পর এক অপারেশন! তবে, সবথেকে নির্মম ও ভয়াবহ ‘অপারেশন’ বোধহয় ছিল- ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার মুখে শিলদার ইএফআর ক্যাম্পে চালানো ভয়ঙ্কর হামলাই। গুলি আর আগুনে ঝলসে গিয়েছিল অজস্র জওয়ানের দেহ। শহীদ হয়েছিলেন ২৪ জন EFR জওয়ান! পাশবিক সেই হামলার ঘটনায়, ১৪ বছর পর দোষী সাব্যস্ত ২৩ জন মাওবাদী-কে বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ও বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছেন মেদিনীপুর জেলা আদালতের ষষ্ঠ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক সেলিম শাহী। সেই তালিকায় আছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরের সুভাষগ্রামের আর.এন চক্রবর্তী রোডের বাসিন্দা অর্ণব দামও। বাবা ছিলেন বিচারক, মা শিক্ষিকা। শৈশব থেকেই মেধাবী, রোগা-পাতলা চেহারার অর্ণব বারাসত প্যারীচরণ সরকার রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। তারপর নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে উচ্চমাধ্যমিক। সেখান থেকে আইআইটি খড়্গপুর (IIT Kharagpur)। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অর্ণব হঠাৎ ১৯৯৮ সালে নিখোঁজ হয়ে যান আইআইটি ক্যাম্পাস থেকে! ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাস নাগাদ মাও নাশকতায় যুক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরে জামিনও পান তিনি। তারপর বাড়িতে দু’মাস থাকার পর আবার নিখোঁজ হয়ে যান। প্রাক্তন বিচারকের ছেলে হয়ে যান মাও নেতা বিক্রম। সিপিআই(মাওবাদী) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য। বিহার-ঝাড়খন্ড-ওড়িশা সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক। পুরুলিয়া-পূর্ব সিংভূম-সরাইকেলা খরসোঁওয়া সীমানা জোনাল কমিটি ও পুরুলিয়ার অয্যোধ্যা স্কোয়াডের দায়িত্ব নিয়ে মাও ভিতকে মজবুত করেন এই জঙ্গলমহলে।

২০১০ সালের শিলদা ইএফআর ক্যাম্প হামলার অন্যতম অভিযুক্ত মাও নেতা বিক্রম ২০১২ সালের ১৬ জুলাই পুরুলিয়ার অয্যোধ্যা পাহাড়তলির বলরামপুরের বিরামডি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন। তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার হয় একে ৪৭-র মতো অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। পুরুলিয়ায় গ্রেপ্তারের পর সেখানকার সংশোধনাগার থেকে তাঁর ঠিকানা হয় প্রেসিডেন্সি জেল। সেখানে থেকেই ইগুনু-র মাধ্যমে ইতিহাসে স্নাতক (অনার্স) ও পরে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন। দু’টিতেই পান ফার্স্ট ক্লাস। অধ্যাপক হওয়ার নেশায় বুঁদ অর্ণব ৪০ বছর বয়সে পাস করেন সেট বা স্টেট এলিজিবিলিটি টেস্ট (SET/ State Eligibility Test)। এখন অর্ণবের বয়স ৪৫-র আশেপাশে। এখনও অধ্যাপক হতে চান তিনি। করতে চান রিসার্চ বা গবেষণা। বৃহস্পতিবার নিজের সেই ইচ্ছের কথা জানিয়েছেন বিচারক সেলিম শাহীকে। বিক্রম ওরফে অর্ণব বলেছেন, “কারা আইনে সংশোধনাগারে শিক্ষার অধিকার সকলের রয়েছে। আমি যেন পিএইচডি করতে পারি দেখবেন!” অন্যদিকে, শিলদা মামলার অন্যতম আরেক অভিযুক্ত ঝাড়গ্রামের (তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুরের) বেলপাহাড়ির বাসিন্দা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে (সেকেন্ড ইয়ারে) পড়াকালীন শিলদা মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন (২০১০ সালের জুন মাস নাগাদ)। মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই বুদ্ধেশ্বরের দু’টো কিডনিই বিকল হয়েছে! চলছে ডায়ালিসিস। বলা চলে একপ্রকার মৃত্যুর প্রহর গুনছেন একসময়ের ‘জঙ্গলমহলের ত্রাস’ এই যুবক! অসুস্থ থাকায় বৃহস্পতিবার আদালতে আনা হয়নি বুদ্ধেশ্বর মাহাত ওরফে বুদ্ধদেবকে। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে গিয়েই সাজা শুনিয়েছেন বিচারক সেলিম শাহী। অন্যদিকে, অসুস্থ ছেলের যাবজ্জীবন শোনার পর থেকেই ভেঙে পড়েছেন তাঁর মা নিয়তি মাহাত। তাঁর আক্ষেপ, “ছেলেটাকে আমার কোলে মরতে দিল না!”

thebengalpost.net
বৃহস্পতিবার মেদিনীপুর আদালতে অর্ণব দাম:

বৃহস্পতিবার নিয়তি মাহাত সাংবাদিকদের বলেন, “আমার ছেলের মৃত্যুদণ্ড তো আগেই দিয়ে দিয়েছে! গ্রেপ্তারের পর এমন মারধর করেছে যে আমার ছেলের দু’টো কিডনিই বিকল হয়ে গেছে। এখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত। হাসপাতালে ডায়ালিসিস চলছে। নিজে কিছুই করতে পারে না। আদালতের কাছে একটাই আবেদন করেছিলাম। বলেছিলাম, ‘ছেলেতো আমার মরবেই। এই ক’টা দিন ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। ছেলেটার মৃত্যু হোক আমার কোলে।’ বছর খানেক আগে আদালত আমার অসুস্থ ছেলেটাকে জামিনও দিয়েছিলেন। ভেবেছিলাম ছেলের জীবনের শেষ ক’টা দিন আমি নিজের চোখে দেখবো। তা আর হলো না!” জঙ্গলমহলবাসীর প্রশ্ন, “এটাই কি তবে পোয়েটিক জাস্টিস?”

thebengalpost.net
আদালতে অসহায় মা: