National

Midnapore: “আমার মেয়ের নতুন জন্ম হল যেন”! বাড়ি ফিরলেন দাঁতনের অনন্যা, ফিরলেন খড়্গপুরের প্রবীণ কুমারও

মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৫ মার্চ: মৃত্যুভূমি থেকে মাতৃভূমি-তে ফিরে আসা। ফিরে আসা মায়ের কোলে! কাঁদছেন মা, কাঁদছেন মেয়েও। বাবা বলছেন, “আমার মেয়ের নতুন জন্ম হল যেন!” হ্যাঁ, মৃত্যু উপত্যকা ইউক্রেনের রাজধানী কিভ (Kyiv) থেকে পায়ে হেঁটে হাঙ্গেরি স্টেশন (বুদাপেস্ট স্টেশন)‌। তারপর, হাঙ্গেরি থেকে দিল্লি। দিল্লিতে একদিন কাটিয়ে কলকাতা। কলকাতা থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন (২ নং) এর গড়হরিপুরে নিজের জন্মভূমিতে। শনিবার কাকভোরে বাড়ি পৌঁছে, সাত সকালে সাংবাদিকদের মুখোমুখি অনন্যা পাইক। কিভ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (Kyiv Medical University) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী অন্যান্য’র চোখেমুখে ‘ঘুম’ থাকলেও, মৃত্যুঞ্জয়ী বিজয়িনীর হাসি! অনন্যা বর্ণনা করছিলেন, “২৬ ফেব্রুয়ারি আমাদের হস্টেলের একেবারে কাছাকাছি বোমা পড়েছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালেই আমরা বেরিয়ে যাই। সঙ্গে খাওয়ার বলতে সামান্য চকলেট আর বিস্কুট। আর অল্প জল। ২১ তারিখ থেকে আমরা ভাত খাইনি। শরীরে বল নেই, ভয়ে পা কাঁপছে! শুধুমাত্র মানসিক শক্তি আর জেদকে সঙ্গী করে পায়ে হেঁটে, সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুঝঞ্ঝা উপেক্ষা করতে করতে হাঙ্গেরি পৌঁছই। তারপর, বুদাপেস্ট (হাঙ্গেরির রাজধানী) থেকে ট্রেনে করে এয়ারপোর্টে। তারপর, ভারত সরকারের বিমানে চেপে দিল্লি। এরপর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে দিল্লি থেকে ধাপে ধাপে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে রাজ্য সরকার এবং এখানকার প্রশাসন।” অনন্যা’র বাবা অশোক কুমার পাইক স্মরণ করতে ভুললে না, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সমস্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেও, যে দু’জনের কথা না বললে অন্যায় করা হবে, তাঁরা হলেন, বিজ্ঞানী ড. চিরন্তন চট্টোপাধ্যায় এবং ড. সুকান্ত দাশগুপ্ত। ড. চট্টোপাধ্যায়-ই আমার মেয়েকে সম্পূর্ণভাবে গাইড করে কিভ থেকে হাঙ্গেরি অবধি পৌঁছে যাওয়ার পথ নির্দেশ করে দিয়েছেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে। উনি একসময় উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। এখন, রাঁচি-তে একটি সংস্থায় বিজ্ঞানী হিসেবে নিযুক্ত। ওনাদের দু’জন আর দুই সরকারের জন্যই যেন আমার মেয়ে নতুন জীবন ফিরে পেল!” অনন্যা’র মা অপর্ণা শিকদার পাইক বললেন, “গত ১০-১২ দিন যে আমাদের কিভাবে কেটেছে, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন! অনেক ধন্যবাদ জানাই মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে। ওনাদের কাছে একজন মা হিসেবে শুধু এটুকুই চাইব, সমস্ত সন্তানদের ফিরিয়ে আনুন। কেউ যেন ওখানে আটকে না থাকে!” উল্লেখ্য যে, দু’দিন আগেই ইউক্রেন থেকে বাড়ি ফিরেছে দাঁতনের আরেক পড়ুয়া অর্ণব দাস মহাপাত্রও। শনিবার দুপুরে তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছেন দাঁতনের বিধায়ক বিক্রম চন্দ্র প্রধান।

অনন্যা পাইক (Ananya Paik) :

ইউক্রেন থেকে ফিরে আসা ডাক্তারি পড়ুয়া অর্ণব দাস মহাপাত্র-কে শুভেচ্ছা জানালেন দাঁতনের বিধায়ক বিক্রম চন্দ্র প্রধান :

অপরদিকে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুরের ১৫ নং ওয়ার্ডের প্রবীণ কুমার-ও ফিরে এলেন নিজের বাড়িতে! চোখেমুখে যেন যুদ্ধ জয়ের হাসি। পেলেন, বীরের সম্মান। শুক্রবার রাতে বাড়ি ফিরে আসা বছর ২১ এর প্রবীণ বলছিলেন, “যেন নতুন জীবন ফিরে পেলাম! আমার ২৪ ফেব্রুয়ারিই ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু, ততক্ষণে রাজধানী কিভে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায়, আমার ফ্লাইট ক্যানসেল হয়ে যায়। আমি থাকতাম ভিনিৎসিয়া-তে। ভিনিৎসিয়া ন্যাশনাল মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (Vinnytsia National Medical University) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। কিভ এবং খারকিভের মতো এই এলাকায় লাগাতার বোমাবর্ষণ না হলেও, ওখানেও ক্রমেই যুদ্ধের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল। কারফিউ জারি করা হয়েছিল। আমরা বাংকারে আশ্রয় নিয়েছিলাম ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে। দিনে মাত্র ২ ঘন্টা সাইরেন বাজিয়ে আমাদের খাবার আনতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হত। তারমধ্যেই, যেটুকু খাবার ও জল সংগ্রহ করে ফিরতাম। বাংকারের মধ্যে চারদিন যেন মৃত্যুভয় আঁকড়ে বেঁচে ছিলাম। ২৮ ফেব্রুয়ারি কোনোমতে বর্ডার ক্রস করে হাঙ্গেরি পৌঁছই। এরপর, ভারত সরকারের উদ্যোগে হাঙ্গেরি থেকে দিল্লি পৌঁছই ৩ মার্চ রাতে। সেখান থেকে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে গতকাল রাতে বাড়ি পৌঁছছি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী’র প্রতি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই।” এদিকে, শনিবার সাত সকালেই প্রবীণের খড়্গপুরের বাড়িতে সংবর্ধনা দিতে পৌঁছে যান ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত কাউন্সিলর বান্টা মুরলীধর রাও সহ অনেকেই। তাঁরা সকলেই দুই সরকারকেই ধন্যবাদ জানিয়েছেন‌‌। আর, মন থেকে চাইছেন এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এবার বন্ধ হোক! কালদর্শী ‘কাস্তে কবি’র কথায়, ইস্পাত আর কামানের ঠোকাঠুকিতেই একদিন যুদ্ধবাজ, ক্ষমতালিপ্সু শক্তি ধংস হবে। তবে, তার আগে কত সভ্যতা, কত জনপদ তারা ধ্বংস করে দেবে কে জানে! অনন্যা, প্রবীণ-দের মতো অনেকেই সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে উঠে এসে হয়তো গেয়ে উঠবেন, “তাহার মাঝে আছে দেশ এক- সকল দেশের সেরা…সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।”

প্রবীণ কুমার, কাউন্সিলর বান্টা মুরলীধর রাও-এর সঙ্গে :

News Desk

Recent Posts

Midnapore: শিক্ষা, সাহিত্য, সঙ্গীতের সাথেই মিশে গেল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছটা; ঈশ্বরের আলোয় আলোকিত ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’-এর মঞ্চ

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৫ সেপ্টেম্বর: শিক্ষা, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সমাজজীবনে উল্লেখযোগ্য অবদানের…

14 hours ago

Midnapore: সকাল থেকেই চলছিল অভিযান, পুজোর আগেই কেশিয়াড়ি থেকে পাকড়াও মহারাষ্ট্রের দুই কুখ্যাত দুষ্কৃতী

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৩ সেপ্টেম্বর: গোপন সূত্রে খবর পেয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকেই…

2 days ago

IIT Kharagpur: শত চেষ্টাও বিফলে, ন’মাসে ছয় পড়ুয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যু IIT খড়্গপুরে; ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার গবেষকের

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২১ সেপ্টেম্বর: ফের ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার আইআইটি খড়্গপুরে! শনিবার…

4 days ago

Midnapore: দুর্ভেদ্য নাকা পয়েন্ট, স্টেশন চত্বরে বসছে CCTV; মেদিনীপুরে কুড়মি আন্দোলন ঠেকাতে কড়া জেলা পুলিশ ও রেল

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৯ সেপ্টেম্বর: 'কেউ কথা রাখেনি..!' না রাজ্য সরকার না…

7 days ago

IIT Kharagpur: বিশ্ব উষ্ণায়ন আর মানব সভ্যতার বিবর্তন, বনাঞ্চলে ব্যাহত সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া; IIT খড়্গপুরের গবেষণায় উঠে এলো চমকপ্রদ তথ্য

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, খড়্গপুর, ১৯ সেপ্টেম্বর: গত কয়েক বছরে সবুজায়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে ভারত।…

7 days ago

Midnapore: বাড়ি নয় যেন ‘হাজারদুয়ারি’! কোটি কোটি টাকা প্রতারণা করে সপরিবারে ‘ফেরার’ বেলদার স্বর্ণ ব্যবসায়ী

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৬ সেপ্টেম্বর: বিশাল জায়গার উপর প্রাসাদোপম বাড়ি। উঁচু পাঁচিল…

1 week ago