দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ড. শুভেন্দু ঘোষ: পৃথিবীর অন্যান্য অংশের মতোই বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব থেকে বাদ পড়েছে না হিমালয়ের সুউচ্চ পর্বতগাত্রে থাকা বরফের নদী বা হিমবাহগুলিও। হিমবাহের পশ্চাদপসরণ এর সাথে সাথে ক্রমশ সারা হিমালয় জুড়ে বরফের আবরন ক্রমেই কমে আসছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় ভাবে হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে অবৈজ্ঞানিকভাবে বৃক্ষচ্ছেদনও উষ্ণায়নকে তরাহ্নিত করছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। লিডস ইউনিভার্সিটির গবেষণায় উঠে আসছে এই সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য যা অত্যন্ত উদ্বেগের। লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের করা এই সমীক্ষাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে সাম্প্রতিক দশকগুলিতে হিমালয় অঞ্চলের বিভিন্ন হিমবাহগুলিতে গড়ে প্রায় আগের তুলনায় দশগুণ বেশি দ্রুত বরফের পরিমাণ কমছে যা বিশ্বের অন্যান্য অংশের হিমবাহের তুলনায় অনেক বেশি বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। তাঁরা একইসঙ্গে এই ধরনের ‘বরফের আবরনের ব্যতিক্রমিক সংকোচনের’ ঘটনায় দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়াবাসীকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এই গবেষক দলটি বিগত ৪০ বছরের উপগ্রহ চিত্রের তুলনামূলক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, তা হলো বর্তমানে এই পার্বত্য হিমবাহের প্রায় ৪০℅-৪৫% অঞ্চল বরফমুক্ত হয়েছে। বিগত কয়েক দশকে ২৮০০০ বর্গকিলোমিটার বরফের আবরন সংকুচিত হয়ে প্রায় ১৯৬০০ বর্গকিলোমিটারে পৌঁছেছে, যা আজকের দিনে মধ্য ইউরোপের আল্পস, ককেশাস এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় থাকা সমস্ত বরফের সমতুল্য। এই গবেষ্কদলের প্রকাশিত তথ্য (scientific Reports, 2021) অনুযায়ী এই অঞ্চলের পার্বত্য হিমবাহগুলি থেকে গলে যাওয়া জল সারা বিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৯২ মিমি থেকে ১.৩৮ মিমি পর্যন্ত বাড়িয়েছে।

অধ্যাপক ডক্টর জোনাথন ক্যারিভিক এই ব্যতিক্রমী অবক্ষয়ের হারের এই ত্বরণে বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন। অ্যান্টার্কটিকা এবং আর্কটিকের পরে হিমালয় পর্বতমালা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বরফের আবাসস্থল হওয়ায় একে ‘তৃতীয় মেরুও’ বলা হয়। হিমালয়ের বরফের এই ব্যতিক্রমী গলনের ফলে প্রধান প্রধান সম্ভাব্য বিপর্যয় গুলি হল- হিমালয়ে বরফের আকারে সঞ্চিত জল গলে গেলে ভবিষ্যতে এশিয়া জুড়ে স্বাদু জলের সংকট দেখা দেবে এবং জল চক্রে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, যার প্রভাবে বৃষ্টিপাতের চালচিত্রেও পরিবর্তন আসতে পারে। এছাড়াও গলনের ফলে এই অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে যারা খাদ্য ও শক্তির জন্য হিমালয় থেকে নির্গত এশিয়ার প্রধান প্রধান নদী ব্যাবস্থার উপর নির্ভরশীল। ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা এবং সিন্ধু প্রভৃতি নদীগুলিতে জলসংকট দেখা দিতে পারে, যা ওই অঞ্চলের কৃষিসহ সার্বিক জীবন যাপনে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। পানীয় জলের যোগান, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচের জলে সংকট ভারত, পাকিস্তান, নেপাল,ভুটান ও বাংলাদেশকে সর্বাধিক প্রভাবিত করবে।

ডাঃ ক্যারিভিক বলেছেন, এই সমস্ত আশু বিপর্যয় প্রশমিত করার জন্য আমাদের অবশ্যই জরুরিভাবে কাজ করতে হবে। গ্রীনহাউজ গ্যাস গুলির নির্গমন কমানোর লক্ষে প্রাত্যহিক জীবনে জীবাস্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতেই হবে। নির্বনীকরন এর পরিবর্তে বনসৃজনের মাধ্যমে স্থানীয় তাপমাত্রায় শীতলতা বজায় রাখতে হবে। ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল এবং পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক , ডাঃ সাইমন কুক উল্লেখ করেছেন, “এ অঞ্চলের লোকেরা ইতিমধ্যে এমন পরিবর্তনগুলি দেখছে যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রত্যক্ষ করারও বাইরে” এসব সত্বেও মানুষের মধ্যে এখনও সার্বিক সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আসা করবো এই অঞ্চলের মানুষজন চলমান বিপর্যয়ের সম্মুখীনতা ও ভবিষ্যত আশঙ্কার কথা চিন্তা করে পরিবেশের দীর্ঘস্থায়ীত্বকে সুনিশ্চিত করতে তৎপর হবে। (লেখক ড. শুভেন্দু ঘোষ ভূগোল বিষয়ের বিশিষ্ট শিক্ষক এবং পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘টিয়ার’ (TIEER) এর গবেষক।)










