শশাঙ্ক প্রধান ও অর্ণব দাস, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৫ জানুয়ারি: “B.Sc সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছিল। এতদিনে M.Sc-তে ভর্তি হয়ে যেত। কত স্বপ্ন ছিল ওর! সব শেষ করে দিল ওরা ৩ জন মিলে। আমাদের ফুলের মত নিষ্পাপ মেয়েটাকে….!” গলা বুজে আসে! চোখ ফেটে বেরিয়ে আসে জল। নিজেকে সামলে ফের বলে ওঠেন, “আমরা খুশি। ফাঁসির সাজা হয়েছে দু’জনের। আর, ওদের সাহায্য করেছিল যে মহিলা, তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। আমাদের মেয়েকে তো আর ফিরে পাবো না! অন্তত মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এটাই আমরা চেয়েছিলাম। তবে, ফাঁসির থেকেও যদি আরো কঠিন কিছু শাস্তি হত, বেশি খুশি হতাম! যেভাবে আমাদের মেয়েকে কষ্ট দিয়ে মেরেছিল…নাক, গলা লাঠি দিয়ে চেপে ধর্ষণ করছিল! তারপর, গলায় ওর পরনের পোশাক পেঁচিয়েই খুন করেছিল। আমরা যখন মেয়েকে উদ্ধার করি নাকের হাড় ভাঙা, গলার হাড় ভাঙা। গোটা শরীর রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত!” মঙ্গলবার বিকেলে মেদিনীপুর আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে বলে যান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলার (ডেবরা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী) সেই মৃত কলেজ ছাত্রীর মা। ২০২১ সালের ৩ মে পিংলা থানার জামনা গ্রামের সবার প্রিয় মিষ্টি মেয়েটিকেই ধর্ষণ করে, তারপর নৃশংসভাবে খুন করছিল দুই রাজমিস্ত্রি, যথাক্রমে- বিকাশ মুর্মু ও ছোটু মুণ্ডা। আর, এই পাশবিক ঘটনায় সাহায্য করেছিল দুই রাজমিস্ত্রি-র সহকারী বা জোগাড়ে হিসেবে কাজ করা তপতী পাত্র নামে বছর ৪০’র মহিলা। ঘটনার ২ বছর ২ মাসের মাথায় অপরাধীদের সাজা ঘোষণা করেন মেদিনীপুর আদালতের বিচারক কুসুমিতা দে মিত্র। বিকাশ ও ছোটু-র মৃত্যুদণ্ড এবং তপতী-র যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন বিচারক। ধর্ষক ও খুনিদের চরম শাস্তি হওয়ায় মৃত কলেজ ছাত্রীর বাবা ও মা ধন্যবাদ দেন সরকার পক্ষের আইনজীবী দেবাশীষ মাইতি-কে। এছাড়াও, পুলিশ-প্রশাসন এবং আইন-আদালতের প্রতিও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তাঁরা।

thebengalpost.net
বিকাশ মুর্মু :

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ৩ মে (21/3/2021) পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলা থানার জামনা এলাকায় বিকেল তিনটে নাগাদ ঘটে যায় এক নৃশংস ও মর্মান্তিক ঘটনা। বিধানসভা নির্বাচনের (২০২১) ফলাফল ঘোষণার ঠিক পরের দিনই বিকেল সাড়ে ৩টা নাগাদ বাড়ির ছোট মেয়ের রক্তাক্ত ও বিবস্ত্র দেহ উদ্ধার করে পরিবার। ডেবরা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী, আদরের সোনামনি (ডাক নাম)-কে সেই অবস্থায় দেখেই জ্ঞান হারান মা। তবে, জ্ঞান হারানোর আগেই তিনি উপস্থিত প্রতিবেশী ও পরিজনদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “এদেরকে (বাড়ির দুই রাজমিস্ত্রি এবং এক জোগাড়ে মহিলা) তোরা যেতে দিবিনা! এরাই সর্বনাশ করেছে।” এরপর পালাতে গেলেও দুই রাজমিস্ত্রি এবং তাদের সহকারি মহিলাকে ধরে ফেলেন এলাকাবাসী। মাত্র ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যায় পিংলা থানার পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় তিন জনকে। কলেজ ছাত্রীর দেহের ময়নাতদন্ত, ফরেনসিক সহ নানা পরীক্ষা হয়। পুলিশের তদন্ত এবং ময়নাতদন্ত, ফরেনসিক সহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিটি ফলাফলই জানিয়ে দেয়, ২০ বছরের কলেজ ছাত্রীকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করার পর, পাশবিকভাবে খুন করা হয়। বিকাশ মুর্মু (পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদার বাসিন্দা) ও ছোটু মুন্ডা (ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূমের বাসিন্দা) নামে বাড়ির দুই রাজমিস্ত্রিই এই কাণ্ড ঘটায়। তাদের সহযোগিতা করে তপতী পাত্র (পিংলা থানার তেমাথানির বাসিন্দা) নামে জোগাড়ের কাজ করা মহিলা।

ওই কলেজ ছাত্রীর বাড়িতে রান্নাঘর ও বাথরুম তৈরির কাজ করতে এসেছিল ৩ জন। প্রায় দু-তিন সপ্তাহ ধরে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এক প্রকার পরিবারের বিশ্বস্ততাও অর্জন করে ফেলেছিল তারা। ৩ মে (২০২১) দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর হার্টের অস্ত্রোপচার হওয়া মা-কে শুইয়ে দিয়ে, বাড়ির পেছনের পুকুরে বাসন ধুতে গিয়েছিল কলেজ ছাত্রী। পেপার পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে যান বাবাও। করোনা-পর্ব চলায়, বিকেল তিনটে থেকে নিজের মোবাইল ফোনে অনলাইনে ক্লাস করার কথা ছিল তাঁদের বছর ২০’র মেয়ে তথা ডেবরা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীর। তার মাঝেই সেই বীভৎস বা নারকীয় কান্ড ঘটায় বাড়িতে কাজ করা দুই রাজমিস্ত্রি (বিকাশ মুর্মু ও ছোটু মুন্ডা)। সহযোগিতা করে তাদের সহকারী তথা জোগাড়ের কাজ করা মহিলা (তপতী পাত্র)। বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে, ‘সোনামনি সোনামনি’ ডাক দিয়েও মেয়ের দেখা না পাওয়ায়, নিজের স্বামীকে ঘুম থেকে তুলে দু’জনে মিলে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। তারপরই, পুকুর পাড়ে পিছনের দিকের একটি বাড়ি থেকে রক্তাক্ত ও বিবস্ত্র অবস্থায় আদরের ছোট মেয়েকে উদ্ধার করেন তাঁরা! অবশেষে, প্রায় ২ বছর ২ মাস ধরে চলে সেই নারকীয় হত্যালীলার (ধর্ষণ ও খুন) বিচার পর্ব। ২৭ জন সাক্ষীর বয়ান নেয় আদালত। শেষমেষ, বছর ৩০’র বিকাশ ও বছর ৪০’র ছোটু-র মৃত্যুদণ্ড (ফাঁসি) এবং জরিমানা ঘোষণা করেন মেদিনীপুর আদালতের বিচারক কুসুমিকা দে মিত্র। তপতী পাত্র নামে বছর ৪৫-র মহিলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়। মঙ্গলবার বিকেল ৪টা নাগাদ মেদিনীপুর আদালতে দাঁড়িয়ে ঠিক এমনটাই জানান সরকারি আইনজীবী তথা স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর দেবাশীষ মাইতি। আর, মৃত কলেজ-ছাত্রীর মা বলেন, “এই শাস্তির খুব দরকার ছিল। আমরা তো আমাদের ছোট মেয়েকে আর কোনদিন ফিরে পাবোনা! তবে, যাতে আর কোনো বাবা-মা’র কোল এভাবে না খালি হয়; সেটাই চাইব। মৃত্যুদণ্ডের এই বার্তাটা সমাজে ছড়িয়ে দিন আপনারা!” (ছবি- দেবনাথ মাইতি।)

thebengalpost.net
ছোটু মুন্ডা :

thebengalpost.net
তপতী পাত্র: