মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২১ জুন: “আমার ছোট জা। সম্পর্ক খুবই ভালো। আমি ওকে স্নেহ করি। আমাকেও যথেষ্ট ভালোবাসে ও সম্মান দেয় ও। ২০১৮ সালেও তো আমরা দু’জন দুই দল থেকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তবে, সেবার পঞ্চায়েত সমিতিতে এবং দু’জন দু’টি আলাদা আসন (পাশাপাশি আসন) থেকে। আমি জিতেছিলাম। ও নিজের আসনে অল্প ভোটে হেরে গিয়েছিল। কিন্তু, মনের মধ্যে কোনরকম হিংসা বা জটিলতা না রেখে, ও আমার হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিল। সেই ছবি আমি বাঁধিয়ে রেখেছি।” বুধবার সকালে শালবনীর গোবরুতে নিজের বাড়িতে বসে বললেন বড় জা উষা কুন্ডু। কিছুক্ষণ পরেই ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত নিজের বাড়িতে বসে ছোট জা চন্দনা কুন্ডু বললেন, “সম্পর্কে আগেও প্রভাব পড়েনি। এবারও প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। লড়াইটা নীতি ও আদর্শের। দু’জন দু’জনের বক্তব্য নিয়ে মানুষের কাছে যাচ্ছি। আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্কে এর কোন প্রভাব পড়বে না।” পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনী ব্লকের ৩টি জেলা পরিষদ আসনের মধ্যে অন্যতম একটি (৫৭নং জেলা পরিষদ আসন) আসন থেকে এবার যথাক্রমে ‘ঘাসফুল’ (ঊষা কন্ডু) ও ‘পদ্মফুল’ (চন্দনা কুন্ডু) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কুন্ডু পরিবারের এই দুই গৃহবধূ। একই পাড়াতে পাশাপাশি বসবাস। দু’জনই নিজেদের সংসার নিয়ে সুখে-শান্তিতে এবং পারস্পরিক সদ্ভাব বজায় রেখে বসবাস করছেন। দু’জনই জানিয়েছেন, “নির্বাচনের ড়াইটা হবে উন্নয়নের বার্তা নিয়ে, দলীয় নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে। এতে প্রভাব পড়বে না আমাদের ব্যক্তিগত সুসম্পর্কে!”

thebengalpost.net
ঊষা কুন্ডু :

এক ধাপ এগিয়ে বুধবার সকালে তারাঁ এও জানান, “প্রার্থী যদি অন্য কেউও হতো, তবুও আমরা ব্যক্তিগত আক্রমণ করতাম না। লড়াইটা নীতি ও আদর্শের। মানুষ যাকে চাইবে সেই জিতবে। কিন্তু, ব্যক্তিগত কুৎসা বা আক্রমণ করা- এসব আমরা পছন্দ করি না।” কর্ণগড় ১০ নম্বর অঞ্চলের গোবরুর বাসিন্দা এই দুই জা-ই পরস্পরের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে জানিয়েছেন, “ও ওর মত কাজ করে। আমি আমার মত। ব্যক্তিগত আক্রমণ বা কুৎসা করার মত মানুষ আমরা নই। নির্বাচনের পরেও পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা বজায় থাকবে।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শালবনীর ১০ নং কর্ণগড় অঞ্চলের গোবরুর বাসিন্দা প্রয়াত লোচন কুন্ডু’র স্ত্রী ঊষা কুন্ডু ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের জেলা পরিষদের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী হিসেবে জয় লাভ করে শালবনী পঞ্চায়েত সমিতির শিক্ষা কর্মাধক্ষ্য হিসাবে কাজ করেন। দল এবার তাঁকে জেলা পরিষদের আসনে প্রার্থী করেছে। তাঁর স্বামী লোচন কুন্ডু কর্নগড় গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলেন। তিনি সিপিআইএম করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ‘দিদি’ (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়)-র প্রতি আবেগ, ভালোবাসা ও মুগ্ধতা থেকে তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত হন ঊষা। বলেন, “দিদির কাজকর্ম বলুন বা উন্নয়নমূলক নানা প্রকল্প ও কর্মসূচি, এসব কিছুতে মুগ্ধ বা আকৃষ্ট হয়েই আমি সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করি। আর, আমার দল আমাকে যে সম্মান ও জায়গা দিয়েছে তাতে আমি কৃতজ্ঞ। যতদিন বেঁচে থাকব দিদির সঙ্গেই থাকব, তৃণমূলের সঙ্গেই থাকব।” স্বামী বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্বীকার করে নিয়েও এমনটাই জানান শালবনী ব্লক মহিলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী তথা পঞ্চায়েত সমিতির বিদায়ী কর্মাধ্যক্ষ ঊষা কুন্ডু।

অপরদিকে, প্রয়াত লোচন কুন্ডুর ভাই গোপাল কুন্ডু’র স্ত্রী চন্দনা কুন্ডু সক্রিয় রাজনীতিতে নামেন ২০১৭ সালে। তাঁর বড় জা ঊষা কুন্ডু যতোটা দিদি ভক্ত, চন্দনা ঠিক ততোটাই মোদী ভক্ত! ঊষা মানুষের কাছে যাচ্ছেন দিদির উন্নয়নের বার্তা এবং ৬৭টি জনমুখী প্রকল্পের তালিকা নিয়ে। আর, চন্দনা একই এলাকার মানুষের কাছে যাচ্ছেন মোদিজীর ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ আর ‘আত্মনির্ভর ভারত’- এর বার্তা নিয়ে। দুই ফুলের দুই প্রার্থীই চান এলাকার উন্নতি করতে। চন্দনা বলেন, “২০১৫ সাল থেকেই বিজেপি অর্থাৎ মোদিজীর ভক্ত হয়ে পড়ি। ২০১৭ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিই। অবশ্য এলাকায় আমি দীর্ঘদিন ধরেই সাধারণ মানুষের পাশে থেকেছি। যখন যেটুকু পেরেছি, অসহায় মানুষদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। তাঁরাই চেয়েছিলেন আমি রাজনীতিতে নেমে আরো ব্যাপকভাবে মানুষের জন্য কাজ করি। ২০১৮ সালেও পঞ্চায়েত সমিতিতে আমি বিজেপির প্রার্থী হিসেবে লড়াই করি। তবে, ১৯৮ ভোটে হেরে যাই। এবার মানুষের কাছে দুর্নীতি মুক্ত পঞ্চায়েত ও উন্নয়নের বার্তা নিয়ে যাচ্ছি। মনে তো হচ্ছে মানুষ এবার আমার পাশে থাকবেন।” হাসিমুখে জানান চন্দনা। জয়ের বিষয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসী ঊষা জানান, “আপনারা জানেন ব্লক মহিলা তৃণমূলের সভানেত্রী হিসেবে আমার নেতৃত্বে চলো গ্রামে যাই কর্মসূচি হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে গ্রামে গিয়ে আমি বুঝেছি, গ্রামের মহিলা সহ আপামর সাধারণ মানুষ অত্যন্ত খুশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা-মাটি-মানুষের সরকারের পরিষেবায়। তারাঁ বলছেন, ‘এখন আমরা বিনা পয়সাতেই সব পাচ্ছি। বিভিন্ন ভাতা ও প্রকল্পের সুবিধা সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে। খুব ভালো আছি আমরা।’ এমনকি লক্ষ্মীর ভান্ডার, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতার ফলে গ্রামের গরিব মহিলাদের হাতে যথেষ্ট অর্থও থাকছে। তাই, মানুষ দু’হাত তুলে এবারও আমাকেই আশীর্বাদ করবেন।” তবে, ফলাফল যাই হোক না কেন, দু’জনই এক সুরে বলছেন, “জিতলেই ফুল নিয়ে পৌঁছে যাব আমার জায়ের কাছে। প্রথম অভিনন্দনটা আমিই জানাবো।”

thebengalpost.net
চন্দনা কুন্ডু :