Special Article

মাছ-মাংস দূর হটো, মেদিনীপুরের পাত জুড়ে শুধুই কাড়ান ছাতুর জয়গান! জঙ্গলমহলে জন্ম নেওয়া জনপ্রিয় এই খাদ্যবস্তুটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন

দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, মেদিনীপুর, ৪ সেপ্টেম্বর: মাছ-মাংস সরিয়ে রেখে মেদিনীপুরের খাদ্যরসিকরা এখন মেতেছেন কাড়ান ছাতুর (Stick Mushroom ????) অপূর্ব স্বাদ ও গন্ধে! এই ক’দিন ধরে তাই রান্নাঘরের প্রধান পদ ‘কাড়ান ছাতু’র নানা তরি-তরকারি বা ভাজা কিংবা পোস্ত। জঙ্গলমহল ছাড়িয়ে জেলা শহর মেদিনীপুরে দেদার বিকোচ্ছে কাড়ান ছাতু বা দুর্গা ছাতু বা অষ্টমী ছাতু। দামও কাছাকাছি খাসি মাংসের মতোই! তবে, তা শুধু শহরে। জঙ্গলমহল এলাকায় এর দাম মাছ বা মুরগি মাংসের মতোই। শুক্রবার ও শনিবার মেদিনীপুরে ব্যাপক আমদানি হওয়া কাড়ান ছাতু বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে। অপরদিকে, জঙ্গলমহল পশ্চিম মেদিনীপুরের পিড়াকাটা, শালবনী, গোয়ালতোড়ে সেখানে দাম মাত্র ২০০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে! প্রাকৃতিক ভাবেই জন্ম নেওয়া এই ছাতু বিখ্যাত তার অপরূপ স্বাদ ও গন্ধের জন্য। এবার, পরিবেশ বন্ধু রাকেশ সিংহ দেবের কলমে পড়ে নিন এই ছাতু সম্বন্ধে বিস্তারিত।

মেদিনীপুর কলেজ রোডে দেদার বিকোচ্ছে এই ছাতু (নিজস্ব ছবি) :

ছাতু হাতে জঙ্গলমহলের যুবক তন্ময় মল্লিক (গোহালডিহি, ছবি- রাকেশ‌ সিংহ দেব) :

কাড়ান ছাতুর কিসসা (রাকেশ সিংহ দেব): জঙ্গলমহলের পর্ণমোচী শাল জঙ্গল ও তার পাশ্ববর্তী এলাকার ঝোপ, জমির আল বা জঙ্গল সংলগ্ন এলাকার মানুষের কাঁচা বাড়িতেও মাটি ফুঁড়ে বর্ষাকালের শেষের দিকে বিশেষ করে জন্মাষ্টমী তিথির পাশাপাশি সময় থেকেই কাড়ান ছাতুর (Termitomyces Heimii) আবির্ভাব ঘটে। তবে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এই ছাতু সর্বাধিক পাওয়া যায়। অন্যান্য Termitomyces ছাতুর মতো উইঢিবির সাথে এই ছাতুর বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। উই ঢিবি এবং তার আশেপাশের ল্যাটেরাইট মাটির উপর বেশিরভাগ সময় বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে মাটি ভেদ করে সাদা হয়ে ফুটে থাকে। এরকম জায়গা যেখানে কাড়ান ছাতু ফুটে থাকে সেগুলিকে জঙ্গলমহলের ছাতু কুড়ানিরা ‘আড়া’ বলে থাকে। একটি ছাতুর আড়াতে প্রতিবছর ছাতু পাওয়া যায়। অভিজ্ঞ ছাতু কুড়ানিরা তাই এইসব আড়াগুলি চিনে রাখে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে নিয়ে অনুজপ্রতিম প্রাবন্ধিক অভিজিৎ মাহাত তার বাড়ির সামনের বাঁশঝোপের এক ছাতু আড়ার মাটি খুঁড়ে, মাটির কিছুটা নীচে বড় বোলতার চাকের মতো অংশ পায় যেটার গায়ের বিভিন্ন খাঁজ থেকে ছাতুর কলি বের হচ্ছে। এর থেকে একই ছাতু আড়া থেকে বছর বছর কাড়ানি ছাতু পাওয়ার কারণটি বোঝা যায়। এইজন্য এই ছাতুর লম্বা ডাঁটাটি সম্পূর্ণ তুলে আনা সম্ভব হয়না, সবসময় গোড়ার দিকের কিছু অংশ ছিঁড়ে মাটিতে রয়ে যায়। এই ছাতু তিন দিন ধরে নির্দিষ্ট আড়া ও তার পাশাপাশি জায়গায় পাওয়া যায়। প্রথম দিন ছাতুটি কুড়ি অবস্থায় পাওয়া যায়, দ্বিতীয় দিনে অর্ধফোটা ও তৃতীয় দিনে ছাতু পুরো ফুটে ছাতার মতো আকার নেয়। কাড়ান ছাতুর মরসুমে শেষ রাতে দিনের আলো ফোটার আগে অন্ধকারে হিমের চাদর জড়িয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে ছাতু সন্ধানীরা। মরসুমে কিছু টাকার আশায়। বছরের একটা বাড়তি রোজগারের উৎস হওয়ায়, এই ছাতুকে জঙ্গলবাসীরা কেউ অবহেলা করতে চায়না। সাধারণভাবে মরশুমে ছাতু তুলতে ভোর চারটে থেকেই মানুষ জঙ্গলে উপস্থিত হয়ে যায়। পুরুষ, মহিলা এমনকি খুদে বাচ্চারাও ছাতু সংগ্রহের ব্যাপারে সক্রিয়। তবে মহিলাদেরই এ ব্যাপারে ভূমিকা বেশী। সাধারণত পাড়াপড়শীর মেয়েরা ছোট ছোট দল করে রাত থাকতেই জঙ্গলে হাজির হয়। হাতে থাকে ঝুড়ি বা ছোট থলে। কখনও আঁচলে বা গামছার খুঁটে বেঁধে নিয়ে আসে জঙ্গলের ধন। আগের রাত্রে বৃষ্টি হলে সংগ্রহকারীদের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি হলে অনেকে বিকেলের দিকেও ছাতু সংগ্রহ করে। শুধু বয়স্করাই নয়, এখানকার ছোট বাচ্চারাও খাবার ছাতু ভালোভাবেই চেনে। কুঁড়ি ছাতু খেতে অধিক সুস্বাদু এবং সকলের খুব বেশি প্রিয়। কাড়ান ছাতু রান্না করার কয়েকটি প্রচলিত পদ্ধতি রয়েছে। সব ভোজ্য ছাতুর মতো কাড়ান ছাতুকেও সাধারণত মশলা ও সরষের তেল দিয়ে কষে রান্না করা যায়। জঙ্গলমহলের অধিবাসীরা জঙ্গলের এই ছাতু সংগ্রহ করে বিভিন্ন ধরনের রেসিপি বানান। কাড়ান ছাতুর ভাজা থেকে মশলা দিয়ে ঝাল হয়ে চালের গুঁড়ো মিশিয়ে পিঠে পর্যন্ত – কি না হয় এই ছাতু দিয়ে! কাড়ান ছাতু দিয়ে বানানো পিঠে অত্যন্ত সুস্বাদু এবং এগুলি জঙ্গলমহলের আদি ও অকৃত্রিম রেসিপিও বটে। অনেকে আবার কচি ঝিঙ্গা দিয়েও রান্না করে থাকে। জঙ্গলমহলের প্রচলিত সংস্কার অনুসারে ভিটের ছাতু খাওয়া নিষেধ। কাড়ান ছাতু অনেকসময় গৃহস্থ বাড়ির আশেপাশের মাটিতে, ঝোপঝাড়ে জন্মে থাকে। যাদের বাড়ীর এলাকার মধ্যে ছাতু জন্মায় তাদের সেই ছাতু খাওয়া প্রচলিত সংস্কার মতে নিষিদ্ধ। এই ছাতুগুলো অন্যরা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ার কারণে বাজারে আমদানি হওয়া মাত্রই কাড়াকাড়িতে বিক্রি হয়ে যায়। যার থেকে এই ছাতুর নাম হয়েছে কাড়ান ছাতু।

রাকেশ‌ সিংহ দেবের তোলা কাড়ান ছাতুর ছবি :

রাধাঅষ্টমী, ঈদ, একাদশী, সীতাষ্টমী, দূর্গা অষ্টমী প্রভৃতি বিশেষ বার, তিথির সময়ক্ষণ অনুযায়ী এসব ছাতুর আধিক্য দেখা যায়! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ছাতুদের প্রচলিত নাম স্থান ভেদে পরিবর্তন হতে পারে। দুর্গা পুজার আগে যে কাড়ান ছাতু হয়, তাকে বলে আউলি কাড়ান আর দুর্গা পূজার সময় যে কাড়ান ছাতু হয়, তাকে বলে দুর্গা কাড়ান। কাড়ান ছাতু অষ্টমী তিথির আগে-পরে হয় বলে একে অষ্টমী ছাতুও বলা হয়। পরিণত ছাতুটি দেখতে সাদা রঙের ছাতার মতো। সাদা রঙের মাঝখানের উপরিতল কিছুটা কালচে ধূসর রঙের । টুপির নিম্নাংশ অনেক গিলযুক্ত – যা একটা সাদা রঙের দীর্ঘ বৃন্ত বা ডাঁটার (স্টাইপ) সঙ্গে যুক্ত হয়ে মাটির নিচ অবধি বিস্তৃত গ্রাম্য ভাষায় যাকে সিক বলে। এইজন্য অনেকে সিক ছাতু বলে থাকে। তবে বর্তমান সময়ে বিরূপ আবহাওয়া, অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, জঙ্গলের আগুন ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে কাড়ান ছাতুর পরিমাণ অনেকটাই কমে গেছে। ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে কাড়ান ছাতুর আবাস শাল, মহুল জঙ্গলের পরিসর। তাইতো জঙ্গলমহলের লোককবি আক্ষেপের সুরে বলেছেন –
বন কুঁদরি আর কাড়হা্ন ছাতু-
একদিন কুড়হাঁয় আইন্‌থ লধা ফাতু-
মহুলবনি গাঁয়ে একটাও মহুল গাছ নাঁয় ভায়। – (‘অরণ্যের কাব্য’ স্বর্গীয় লোককবি ভবতোষ শতপথী।)
কাড়ান ছাতুর বিজ্ঞানসম্মত নাম – Termitomyces Heimii
চেনার উপায় : টুপি– ৮ সেমি থেকে ১২ সেমি ব্যাসের। কেন্দ্রের চারপাশে কিছুটা জুড়ে গোল কালো বা বাদামী রঙ থাকে। টুপির উপরের অংশ মসৃণ ও পিচ্ছিল। কুঁড়ি অবস্থায় টুপিটিকে ডিম্বাকার লাগে। ছাতু সম্পূর্ণ ফুটে গেলে উপরের তল ধূসর ও হালকা।
ডাঁটা– টুপির নীচে মাঝ বরাবর জোড়া। নরম এই ডাঁটা ১৯ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
গিলস- মুক্ত, ঘন, নরম, সাদা।
রেনুর ছাপ- সাদা বা গোলাপী।
খাদ্যগুন: মানবদেহের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে এই ছাতুর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ছাতুতে প্রয়োজনীয় মাত্রায় কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট এবং খনিজ পদার্থ থাকে।

এভাবেই জন্মায় কাড়ান‌ ছাতু (ছবি- রাকেশ‌ সিংহ দেব) :

News Desk

Recent Posts

Vidyasagar University: আবহাওয়ার নিখুঁত খবর জানতে ISRO-র সহযোগিতায় আকাশে যন্ত্র লাগানো বেলুন পাঠাল বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৩ জুন: রবিবার (২২ জুন) দুপুর ঠিক ২টো ১…

24 hours ago

Midnapore: “১৯৭৮-এর পর এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেনি গড়বেতা!” আসরে NDRF-SDRF; প্লাবন পরিস্থিতি চন্দ্রকোনাতেও

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২০ জুন: ১৯৭৮ সালের পর এমন ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির…

4 days ago

Midnapore: মিয়াজাকি, ব্ল্যাকস্টোন থেকে আম্রপালি, হিমসাগর; মেদিনীপুরে জমজমাট ‘আম উৎসব’

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৮ জুন: ৩০ টাকা প্রতি কেজি থেকে ৩ লক্ষ…

6 days ago

Kharagpur: খড়্গপুরের কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ! মৃত্যু এক শ্রমিকের

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, খড়্গপুর, ১৭ জুন: গ্লিসারিন কারখানায় ওয়েল্ডিং- এর কাজ চলাকালীন ভয়াবহ বিস্ফোরণ!…

1 week ago

Midnapore: প্রায় দু’দশক পরে পশ্চিম মেদিনীপুরে শুরু হয়েছিল প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া; থমকে গেল আদালতের নির্দেশে

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৬ জুন: ২০০৮ এর পর ২০২৫। দীর্ঘ প্রায় দুই…

1 week ago

Elephant: হাতির পালকে তাক করে ছোঁড়া হচ্ছে একের পর এক জ্বলন্ত হুলা; নেটমাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে পড়তেই নিন্দার ঢল

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, খড়্গপুর, ১৩ জুন: হাতির পালকে তাক করে ছোঁড়া হচ্ছে একের পর…

2 weeks ago