দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৭ জানুয়ারি: জন্মগত ত্রুটি থাকায় ৬ মাসের শিশুকে ছুঁড়ে ফেলতে এক মুহূর্তের জন্যও হয়তো হাত-পা কাঁপেনি জন্মদাতা বাবা-মায়ের! খবর পাওয়ার পর খড়্গপুর স্টেশন থেকে উদ্ধার করে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের অধীন শিশু সুরক্ষা দপ্তর। রাখা হয় জেলা শহর মেদিনীপুরের উপকন্ঠে রাঙামাটি এলাকায় অবস্থিত বিদ্যাসাগর বালিকা ভবনে (সরকারি হোমে)। নাম দেওয়া হয় সঙ্গীত। সযত্নে লালন-পালন করার সাথে সাথেই, সঙ্গীতের সমস্ত ধরনের চিকিৎসা করানো হয় হোম কর্তৃপক্ষ তথা শিশু সুরক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে। জাঁকজমক সহকারে হোমেই হয় তার অন্নপ্রাশন। এখন সঙ্গীতের বয়স প্রায় চার। সম্পূর্ণ সুস্থ সে। দেখে বোঝার উপায়ই নেই প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে সে ছিল এক স্পেশাল চাইল্ড বা বিশেষভাবে সক্ষম শিশু! স্পষ্ট বাংলার সাথে সঙ্গীত এখন আধো আধো ইংরেজি বলতেও শিখেছে। সরকারি হোমের সকলের প্রিয় সেই সঙ্গীত-ই আজ, মঙ্গলবার সকালে তার নতুন বাবা-মা’র হাত ধরে পাড়ি দিল আমেরিকার নিউ জার্সি। তাকে দত্তক নিয়েছেন নিউ জার্সির দম্পতি, পেশায় ব্যবসায়ী যশুয়া লরেন্স (Joshua Lieurance) এবং রাঁভে লরেন্স (Raven Lieurance)।
সোমবার বিকেলে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসকের কার্যালয়ে জেলা প্রশাসন তথা জেলা শিশু সুরক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে সঙ্গীতকে সরকারিভাবে (অফিসিয়ালি) তুলে দেওয়া হয়েছে নিউ জার্সির দম্পতি যশুয়া লরেন্স (Joshua Lieurance) এবং রাঁভে লরেন্স (Raven Lieurance)-র হাতে। রাঁভে জানান, “সঙ্গীত আমাদের নতুন বছরের সেরা উপহার। আমাদের দুই কন্যা আছে। একজনের বয়স ৬ বছর। আরেকজনের ৩ বছর। আমরা একটি পুত্রসন্তান দত্তক নিতে চেয়েছিলাম। এজেন্সির মাধ্যমে অনলাইনে সঙ্গীতকে দেখেই আমাদের পছন্দ হয়। আমাদের দুই মেয়ের মাঝখানে সঙ্গীত। আমার দুই মেয়ে সঙ্গীতের জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে আছে।” সম্পূর্ণরূপে সুস্থ কোনও শিশুর পরিবর্তে সঙ্গীতকেই কেন দত্তক নিলেন? রাঁভে বলেন, “ও খুব স্মার্ট (He is Very Smart)। ও একদম পারফেক্ট (He is totally Perfect)।” পেশায় একজন মাংসের ব্যবসায়ী যশুয়া বলেন, “আমাদের কাছে এটা কোনও বিষয়ই নয়!” সোমবার বিকেলে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের তরফে অতিরিক্ত জেলাশাসক কেম্পা হোন্নাইয়া, মৌমিতা সাহা, শিশু সুরক্ষা দপ্তরের আধিকারিক সন্দীপ দাস প্রমুখের উপস্থিতিতে যশুয়া ও রাঁভে-র হাতে পাসপোর্ট সহ যাবতীয় কাগজপত্র তুলে দেওয়া হয়।
এদিকে, সঙ্গীতের বিদায় বেলায় কেঁদে ভাসালেন তার ‘পালিকা মা’ অনিমা মাহাত। চোখে জল সোনামণি মাণ্ডিরও। হবে নাই বা কেন! মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বালিকা ভবনে গত সাড়ে তিন বছর ধরে তাঁদের কাছেই মানুষ হয়েছে ছোট্ট সঙ্গীত। সোমবার গোধূলি বেলায় অনিমা যখন সঙ্গীতকে তুলে দেন রাঁভের কোলে; হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেন বছর ২৫-র অনিমা। তাঁর নিজেরও ছোটো ছোটো দুই ছেলে আছে। তারা ঝাড়গ্রামে, বাড়িতে থাকে। পেশাগত কারণে অনিমাকে থাকতে হয় আবাসিক বিদ্যাসাগর বালিকা ভবনেই। ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা সোনামণিকেও তাই! দু’জনই প্রায় ৫ বছর ধরে এই হোমে আছেন। সন্তানস্নেহে লালন পালন করে চলেছেন সঙ্গীতদের। স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গীতের বিদায় লগ্নে কান্না ধরে রাখতে পারেন নি তাঁরা। অনিমা-কে জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করেন যশুয়া মাইকেল লরেন্স। বলেন, “ওকে আমরা খুব ভালো রাখব। একদম চিন্তা করোনা। মন খারাপ করো না! ও আমাদের নতুন বছরের সেরা উপহার!” অনিমা, সোনামণির সাথে সাথেই যশুয়া আর রাঁভে-র চোখেও তখন জল! সেই সময়ই আধো আধো ইংরেজিতে সঙ্গীত বলে ওঠে, “হ্যাপি নিউ ইয়ার!” পড়ন্ত বিকেলে তৈরি হয় এক আবেগঘন মুহূর্ত!