Salboni

Midnapore: রামের হাতে তৈরি হয় মহিষাসুর, দুর্গা নয় শালবনির এই গ্রামে ‘হুদুরদুর্গা’-র পুজো করেন সাঁওতালরা

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৪ সেপ্টেম্বর: “তোমরা যাকে মহিষাসুর বলো, আমরা তাকেই বলি হুদুরদুর্গা (বা, হুদুড়দুর্গা)। উনি (হুদুরদুর্গা) আমাদের রাজা ছিলেন। দুর্গা দেবী তাঁকে বধ করেন। তাই আমরা দুর্গা দেবীর পূজা করিনা। ‘হুদুরদুর্গা’-র পূজা করি…!” ঠিক এমনটাই বলেন জঙ্গলমহল পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনী ব্লকের প্রত্যন্ত কেন্দাশোল গ্রামের বাসিন্দা সিজেন হাঁসদা, সুভাষ হাঁসদা, সারথী মান্ডি, রবিনাথ হাঁসদারা। সপ্তমীর দিন ঘটা করে তাঁরা ‘হুদুরদুর্গা’-র পুজো করেন। সকাল থেকে শুরু হয় পুজো। পুজোয় ব্যবহার করা হয় গোটা ফলমূল। দুপুরের মধ্যেই পুজো শেষ হয় যায়। তারপর খাওয়া-দাওয়া করে নিজেদের সংস্কৃতি মেনে আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠেন আদিবাসী বা সাঁওতাল সম্প্রদায়ের এই মানুষজন। সারারাত অনুষ্ঠান হয়। একরাতের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় ‘হুদুরদুর্গা’-র পুজো। তবে, এই মূর্তি বা প্রতিমা তাঁরা বিসর্জন করেননা! সিজেন, সুভাষ, সারথীরা বলেন, “উনি (হুদুরদুর্গা) আমাদের রাজা। তাই ওঁকে বিসর্জন দিতে দিইনা। মণ্ডপ থেকে সরিয়ে কোন ফাঁকা জায়গায় রেখে দিই।” রোদে-জলে ক্ষয় পেতে পেতে তা মাটিতে মিশে যায়। পরের বছর আবারও নতুন মূর্তি গড়েন কেন্দাশোল গ্রামের রামচন্দ্র হাঁসদা।

ছবির মতো সজানো গ্রাম কেন্দাশোল:

বিজ্ঞাপন (Advertisement):

জঙ্গলে ঘেরা অনিন্দ্য-সুন্দর প্রকৃতির মাঝে শালবনীর এই কেন্দাশোল গ্রাম। গ্রামে ২৫-৩০টি আদিবাসী বা সাঁওতাল পরিবারের বাস। আছে সরকারি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও। আধুনিকতার হাত ধরেই গ্রামে পৌঁছেছে বিদ্যুৎ। আছে পানীয় জলের সুবন্দবস্তও। তবে, সিজেন, সুভাষ, রামচন্দ্রদের পাকা বাড়ি নেই। প্রত্যেকেরই একতলা বা দোতলা মাটির বাড়ি। প্রকৃতির মতোই সুন্দর সেই বাড়িগুলি। আদিবাসী সংস্কৃতি মেনেই বাড়ির বাইরের দেওয়ালে রঙিন আল্পনা এঁকেছেন সাঁওতাল রমনীরা। দু-একটি অবশ্য আবাসের বাড়ি অর্ধেক নির্মিত অবস্থায় রয়েছে। তবে, এসব নিয়ে তেমন অভিযোগও নেই গ্রামবাসীদের। জঙ্গলের শালপাতা বিক্রি করে, দিনমজুরি বা শ্রমিকের কাজ করে আনন্দের সঙ্গেই দিন কাটান তাঁরা। এই গ্রামেরই রামচন্দ্র হাঁসদা মূর্তি গড়েন। মৃৎশিল্পী বললেও ভুল হয়না। সারা বছর ধরেই তিনি কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, বিশ্বকর্মা, মনসা প্রভৃতি দেবদেবীদের মূর্তি গড়েন। দুর্গা ঠাকুরের মূর্তিও গড়তে পারেন। নিজের গ্রামে অবশ্য দুর্গা নয়, ‘হুদুরদুর্গা’-র মূর্তিই গড়েন তিনি। তাঁর গড়া সেই মূর্তিই পূজিত হয় সপ্তমীর দিন।

গ্রামবাসীরা:

রামচন্দ্ররা চার ভাই। বড় সিজেন হাঁসদাই বছর দশেক আগে (২০১৬ সালে) এই গ্রামে (কেন্দাশোলে) ‘হুদুরদুর্গা’ পুজো করার উদ্যোগ নেন। সেজ ভাই রামচন্দ্র যেহেতু মৃৎশিল্পী, তিনিই মূর্তি গড়ার দায়িত্ব নেন। মেজভাই সুভাষ হাঁসদা এই হুদুরদুর্গা পুজোর পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। আর তাঁদের ছোট ভাই লক্ষ্মণ হাঁসদা, সারথী মান্ডি, রবিনাথ হাঁসদা, ভারতী মান্ডি, রাইমনি হাঁসদা সহ অন্যান্য গ্রামবাসীরা পুজোর নানা আয়োজন করেন। কেন্দাশোল গ্রামের বাসিন্দাদের সহযোগিতা করেন আশেপাশের সুন্দরপুর, বড়কেঁউদি গ্রামের সাঁওতাল পরিবারগুলিও। এই একটা দিন এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা হুদুরদুর্গার পুজোতে মেত ওঠেন। সিজেন শোনান, “আমরা অনার্য জাতির মানুষ। আমাদের রাজা ছিলেন হুদুরদুর্গা। তাঁকে বধ করার জন্য আর্যরা একজন নারীকে পাঠান। ওই নারীই দুর্গা দেবী! তাই আমরা দুর্গা দেবীর পুজো করিনা। হুদুরদুর্গার পুজো করি। আপনারা একেই মহিষাসুর বলেন।” ঝাড়খণ্ড, পুরুলিয়া সহ বিভিন্ন সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকাতে এই পুজো হয় বলে সিজেন, সুভাষদের দাবি। সিজেন, সুভাষ, রামচন্দ্ররা এও বলেন, এই হুদুরদুর্গা পুজোর দিন থেকে অর্থাৎ সপ্তমীর দিন থেকে দুর্গাপুজোর ক’টা দিন তাঁরা দাশাই (বা, দাঁশাই) নাচ করেন। মহিলা বা নারীদের পোশাক পরিহিত হয়ে, ভুয়াং নামক বাদ্যযন্ত্র সহযোগে পথেঘাটে তাঁরা এই নাচ দেখিয়ে কিছু টাকাপয়সা রোজগার করেন। সেজন্য একে ভুয়াং দাঁশাই নাচও বলে। সিজেন বলেন, “এই দাশাই (বা দাঁশাই নাচ) আসলে দুঃখের নাচ। দেবী দুর্গা আমাদের রাজাকে বধ করার পর, আর্যরা আমাদের তাড়িয়ে দেয়। তখন আমরা নারীর পোশাক পরে, হাতে ‘কাড়বাঁশ’ (তীরধনুক) নিয়ে ‘হায় হায়’ করতে করতে পালিয়ে আসি।” বাংলার লোকসংস্কৃতি গবেষকদের মতে, অনার্য সংস্কৃতির হাত ধরেই আর্য সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এদেশে প্রবেশ করে এবং উভয় সংস্কৃতির মিলন ঘটে। কিন্তু, সেখানে কোনও সংঘাত ঠিক নয়। সাম্প্রতিককালে একটি লোককাহিনীর উপর ভিত্তি করে সাঁওতালদের কেউ কেউ নিজের মতো করে এই হুদুরদুর্গার ‘গল্প’ তৈরি করেছেন। এর সাথে পৌরাণিক কাহিনী তথা দেবী দুর্গা ও মহিষাসুরের কাহিনীর কোনও সংযোগ নেই। বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক ও লেখক ড. মধুপ দে বলেন, “হুদুরদুর্গার পুজোর বিষয়টি প্রাচীন অনার্য সংস্কৃতি বা সাঁওতাল সংস্কৃতির সাথে যুক্ত নয়। অতি সাম্প্রতিককালে কেউ কেউ এটা আমদানি করেছেন। এই বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে একটি লৌকিক কাহিনীর কথা আমি শুনেছি। আদিবাসী সাহিত্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সারিধরম হাঁসদাও আমাকে সেই কাহিনীই শুনিয়েছিলেন। সেই কাহিনী অনুযায়ী, ওড়বান্দা এলাকায় হুদুরদুর্গা নামে এক সাঁওতাল রাজা ছিলেন। তাঁকে কিছুতেই পরাজিত করতে পারছিলেন না অ-আদিবাসী বা অ-অনার্য (আর্যও বলা চলে) রাজারা। আর সেজন্যই এক নারীকে পাঠানো হয়। সেই নারীর ছলনাতেই পরাভূত ও নিহত হন হুদুরদুর্গা। তবে ওই নারী অন্য কোনও নারীর উপর আক্রমণ করেননি। তাই সাঁওতাল পুরুষরাও নারীর ছদ্মবেশ ধরে পালিয়ে যান। ছত্রভঙ্গ হয়ে যান তাঁরা। ওঁরা মনে করেন, ওই দিন থেকেই তাঁদের দুঃখের দিন শুরু। তাই পুজোর ক’টা দিন আমরা যখন আনন্দ করি, ওঁরা দাঁশাই নাচের মধ্য দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে এবং ওঁদের গুরুর কাছে ‘শক্তি ফিরে পাওয়ার’ প্রার্থনা করে। এই কাহিনীর সাথেই পৌরাণিক দুর্গা-মহিষাসুরের কাহিনীকে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা সবসময়ই চাইব উভয় সংস্কৃতির মিলন, সংঘাত নয়। যদিও, কোন সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠীর নিজস্ব বিশ্বাস, সংস্কৃতি চর্চায় আঘাত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।” শালবনী পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নেপাল সিংহ বলেন, “বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই শালবনীর এই গ্রামে আমরা হুদুরদুর্গার পুজোর কথা শুনে আসছি। নিজেদের মতো করে ওঁরা সংস্কৃতি চর্চা বা পূজা-অর্চনা করে থাকেন।”

হুদুরদুর্গা (বা, মহিষাসুরের পুজো):

News Desk

Recent Posts

Midnapore: সাতসকালেই শালবনির জঙ্গলপথে রামলালের দাদাগিরি, চারচাকা গাড়ি উল্টে খাবারের খোঁজ

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১০ সেপ্টেম্বর: জঙ্গলমহলবাসীর প্রিয় হাতি রামলাল। খাবারের খোঁজে এদিক-ওদিক…

3 days ago

Medinipur: জমজমাট ‘খেলা’ নারায়ণগড়ে! তালাবন্দী BDO, পালিয়েও রক্ষে নেই; পিছু নিলেন মহিলারাও

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১০ সেপ্টেম্বর: এযেন সেই ছোটবেলার চোর-পুলিশ খেলা! সামনে দৌড়চ্ছেন…

3 days ago

Midnapore: চুয়াড় বিদ্রোহের আঁতুড়ঘর, নবরূপে সাজবে শালবনীর রানি শিরোমণির গড়; পুজোর আগেই এলো সুখবর

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১০ সেপ্টেম্বর: “কর্ণগড়ের রানি মাগো অস্ত্র ধরেছিল/ কলকাতার লোকে…

3 days ago

Midnapore: “আমরা স্বচ্ছ…সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত”, কালো জামা পরে পরীক্ষাকেন্দ্রে ‘যোগ্য শিক্ষক’ কৃষ্ণগোপাল, মেদিনীপুরে কি বললেন তিনি…

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৭ সেপ্টেম্বর: প্রায় ৯ বছর পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে স্কুল…

6 days ago

Midnapore: ‘১৪ লাখ টাকা লাগবে…’, SSC-র প্রশ্নপত্র বিক্রির ‘ভুয়ো’ পোস্ট ছড়িয়ে মেদিনীপুরে গ্রেপ্তার যুবক

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৫ সেপ্টেম্বর: "আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদ, গত দুই দিন আগে…

1 week ago

NIRF Ranking: দেশের সেরা কলেজের তালিকায় ৪২-তম স্থানে মেদিনীপুর কলেজ, সার্বিক বিচারে নিজের জায়গা ধরে রাখল IIT খড়্গপুরও

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৪ সেপ্টেম্বর: দেশের সেরা কলেজের তালিকায় ৪২-তম স্থানে শহিদদের…

1 week ago