দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৫ নভেম্বর: শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জেলাতেই এ গ্রামের অবস্থান। তবে, তাঁর প্রয়াণের ১৩০ বছর পরেও এ গ্রামে প্রবেশ করেনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা সচেতনতার আলো। তাই, এ গ্রামের ১০-১১ বছরের বালিকারা গর্ভে ধারণ করে সন্তান। আর, ১২-১৩ বছরের “পুতুল খেলার” বয়সে হয়ে যায় সন্তানের জননী! আর, ১২-১৩ বছরের ছেলেরা হয় বাবা! এই গ্রামের পুরুষ-মহিলারা জানেন না তাঁদের জেলার নাম, রাজ্যের নাম কিংবা দেশের নাম। লিখতে পারা কিংবা সই করতে পারা তো দূরের কথা, বর্ণপরিচয়-ই হয়নি তাঁদের। টাকা-পয়সা গুনতেও পারেননা অধিকাংশ জন। মাস-বছর-তারিখ কিছুই জানেনা! এই গ্রামের (বলা ভালো পাড়ার) বাসিন্দা সংখ্যা প্রায় একশো হলেও, চতুর্থ শ্রেণির গন্ডী টপকেছে মাত্র একজনই! আর, এ যাবৎকালে বিদ্যালয়ের মুখও দেখেছে হাতে গোনা কয়েকজন। শুধু তাই নয়, এরা বঞ্চিত সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা থেকেও। জাতিতে খেড়িয়া শবর হলেও, ‘জাতিগত’ স্বীকৃতির বাইরে এদের অবস্থান! পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবংয়ের ৩ নং দাঁড়রা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন খোলাগেড়্যা মৌজার বাগালপাড়া। অশিক্ষা, অজ্ঞতা, অপুষ্টি আর অসচেতনতার অন্ধকারে ডুবে থাকা সেই গ্রামের শিশুদের জন্যই ‘বর্ণপরিচয়’ পাঠশালা খুলেছন দুই শিক্ষক, শান্তনু অধিকারী এবং ভাস্কর ব্রত পতি। অক্টোবর মাস থেকে তা চলছে। আর, গত সপ্তাহেই (১২ নভেম্বর) এই গ্রামে আয়োজিত হয়েছে এ যাবৎকালের প্রথম স্বাস্থ্য ও সচেতনতা শিবির। জানা গেল, এ গ্রামে ‘ঋতুমতী’ হলেই (৯-১০ বছর বয়স থেকে), মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, প্রথম পৌরুষ আসা (১২-১৩ বছরের) ছেলেদের সাথে! তারপর, চলে ‘পুতুল খেলা’র মতোই সংসার। মায়েরাও অপুষ্টিতে ভোগে, আর সন্তানেরাও! দিনরাত দেশি মদ বা চোলাই মদ খেয়ে পড়ে থাকেন গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষ-মহিলা। আর, তাদের ছেলে-মেয়েরা খায় রাস্তায় গড়াগড়ি! এভাবেই দিন কাটে। আসে রাত। ভুখাপেটেই ফের সকাল হয়।
উল্লেখ্য, গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে একটি পুকুরকে ঘিরে এই বাগালপাড়ায় প্রায় তিরিশটি পরিবারের বসবাস। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাড়াটির দূরত্ব মেরেকেটে আটশো মিটার। অথচ সেই স্কুলের চৌকাঠ মাড়ায়নি এখানকার শিশুরা। যে বয়সে হাতে খাতা-কলম থাকা উচিত, সেই হাতে তখন জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা কাঠ, ডালপালা ভরা থাকে। যে বয়সে পিঠে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে চলা উচিত, সেই বয়সে মাথায় চাপে মজুর খাটার নির্দেশ। “পড়াপাঠ আর ভরা পেট” এঁদের জীবনের অঙ্গ নয়! পাড়া জুড়ে চোলাই মদের অফুরন্ত জোগান। এখানে তাই শৈশব থেকেই নেশায় আসক্তি। নাবালক-নাবালিকা অবস্থাতেই বিয়ে, সন্তান ধারণ। রয়েছে চূড়ান্ত অভাব, বঞ্চনা আর অপুষ্টি। প্রতিদিন বাড়িতে চুলা জ্বলে না। হাঁড়িতে চাল পড়ে না। ভুখা পেটে কেটে যায় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রায় সকলেই। সকলেই ভূমিহীন। ভিক্ষা ও দিনমজুরিই উপার্জনের একমাত্র উপায় হলেও, রোজগারের সিংহভাগই খরচ হয় নেশার পেছনে। ফলে নেই কোন মানসিক বিকাশ, নেই স্বাস্থ্য কিংবা সচেতনতার বিকাশও। সেই গ্রামেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর সচেতনতা ফেরাতে বদ্ধপরিকর সবংয়ের শিক্ষক শান্তনু অধিকারী এবং তমলুকের শিক্ষক ভাস্কর ব্রত পতি। তাই, ‘বর্ণপরিচয়’ পাঠশালার পর, বাগালপাড়ায় গত ১২ নভেম্বর আয়োজিত হল, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির। বর্ণপরিচয়ের উদ্যোগে এই শিবিরটি পরিচালনা করেন তুতরাঙা উদীয়মান তরুণ সংঘের একদল তরুণ সদস্য ও চিকিৎসকরা। এই শিবিরে মোট ৭৫ জন বাসিন্দার স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়। বাগালপাড়ার প্রতিটি বাসিন্দার রক্তের গ্রুপও নির্ণয় করা হয়। প্রত্যেককে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় প্রয়োজনীয় ওষুধও। দুই শিক্ষক ছাড়াও, শিবিরে উপস্থিত ছিলেন- জগদীশ মাইতি, হরেকৃষ্ণ মাইতি প্রমুখ। তাঁদের প্রতিটি কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বা দিচ্ছেন গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য মনোরঞ্জন রায়, এমনটাই জানিয়েছেন দুই শিক্ষক ভাস্কর ব্রত এবং শান্তনু। আর, গ্রামে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের আলো একটু একটু করে প্রবেশ করতে শুরু করায়, খুশি ১২-১৩ বছরেই মাতৃত্বের কঠিন দায়িত্ব নেওয়া বুল্টি, সরস্বতী-রা। সমবেত সুরে তারা বলে ওঠে, “আমাদের সঙ্গে যা হয়েছে হয়েছে, আমরা চাই আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করুক, একটু ভালোভাবে বাঁচুক।” সোমবার (১৫ নভেম্বর) দেশজুড়ে যখন ঘটা করে বীরসা মুন্ডার জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে, আদিবাসী অধ্যুষিত এই গ্রামে দাঁড়িয়ে, “এটুকুই প্রাপ্তি” বলে উঠলেন দুই শিক্ষক তথা সমাজকর্মীও! (Edited by Maniraj Ghosh)
***খবরের জের! সবংয়ের বাগালপাড়া গ্রামে প্রশাসনের লোকজন…