Festival

কৃষিভিত্তিক সীমান্তবাংলা মেতে উঠল প্রাণের উৎসব ‘বাঁদনা’ পরবে! পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন প্রান্তে হল ‘গরু খুঁটানো’

দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, রাকেশ সিংহ দেব, ৬ নভেম্বর: সিংভূম, মানভূম তথা অধুনা সীমান্তবাংলার শাল-মহুয়া-পলাশ ঘেরা ভূখন্ডের কৃষিজীবী গরীবগুর্বো মানুষের প্রাণের উৎসব ‘বাঁদনা’। এর, শব্দগত উৎপত্তি সম্পর্কে নানা পণ্ডিতের নানা মত। গ্রাম্য অর্থনীতির মূল ভিত্তি হল কৃষি আর গরু-মহিষ গবাদিপশু ও বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি হলো  কৃষিকাজের প্রধান অবলম্বন। জল-জঙ্গল-জমিন কেন্দ্রিক জীবনযাত্রায় উৎপাদনের হাতিয়ার গবাদি পশুর সঙ্গে কৃষি যন্ত্রপাতির অবদানের কথা স্মরণ রেখে কৃষি কাজে নিযুক্ত কুড়মি জনগোষ্ঠীর মানুষজন তাদের ধন্যবাদ জানাতে বাঁদনা পরব পালন করে। এটা আসলে  তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভাবধারায় সম্পৃক্ত ‘Thanks giving Festival’।

গুরু খুঁটানো : (ছবি- রাকেশ সিংহ দেব)

বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের টোটেমিক কুড়মি জাতির অন্যতম প্রধান উৎসব হল বাঁদনা, এই নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কুড়মি জাতির সংখ্যাধিক্য ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের কারণেই এই পরব আজ একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সম্প্রসারিত হয়েছে সমষ্টির মধ্যে। রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার পূর্বদিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার মৌতাতে ম-ম করে  বাতাস। আর, এই বাঁদনা পরবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় নেগাচার হল ‘গরু খুঁটানো’। কার্তিক অমাবস্যায় শুরু হওয়া পরবের দ্বিতীয়ার দিন অর্থাৎ ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন বিকেলে গাঁয়ের প্রান্তের মাঠে সবাই ভিড় জমায়। শক্ত খুঁটিতে বাঁধা হয় সুপুষ্ট, বলবান, তেজী বলদ আর দুর্দম, উদ্দাম কপিলাদের। সাহসী পুরুষরা তাদের সামনে মৃত পশুর চামড়া ধরে! সমবেত কুলকুলি শুনে উন্মত্তের মতো ফুঁসে ওঠে খুঁটানো গরুটি খুঁটিকে ঘিরে চরকির মতো পাক খায়, কখনো প্রবল বিক্রমে গুঁতো মারে চর্মখণ্ডে! আপাতদৃষ্টিতে এটি বিনোদন হিসেবে মনে হলেও এর পেছনে রয়েছে অতীত পরম্পরার প্রয়োজনীয়তাকে রোমন্থন করা। অরণ্য বেষ্টিত এই ভূখণ্ডটি ছিল শ্বাপদসঙ্কুল। প্রায়ই হানাদার হিংস্র জন্তুর কবলে পড়ত গবাদি পশুরা। কাজেই অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করে নিজেরা। অনুরূপ কসরত শিক্ষা দেওয়া হয় গৃহপালিত পশুদেরও। বর্তমান সময়ের গোরুখুঁটা সেই কসরত শিক্ষারই একটি পরিবর্তিত প্রতীকী রূপ।

গরু খুঁটানো (ছবি- রাকেশ সিংহ দেব) :

বাঁদনা পরবের অন্যতম আকর্ষণ হলো এর ‘অহিরা গীত’ বা গানগুলি। গ্রামে গ্রামে চাষের কাজে সারা বছর ব্যস্ত থাকলেও বাঁদনা পরবের দিনগুলি সম্পূর্ণ বিশ্রাম। রাতে গরু ঘুমাবে, মানুষ জেগে থাকবে। কেউ যাতে ঘুমিয়ে না পড়েন সেই জন্য ধামসা মাদল বাজিয়ে বাড়ি বাড়ি জাগরণ করেন আমুদে গ্রামবাসীরা। এদের ধাঙ্গড়িয়া বা ঝাঁঙ্গড়িয়া বলে। অমাবস্যার রাতে গো-জাগানোর কাজও করে এরা। গৃহস্থেরা এদের পিঠে পুলি দিয়ে খুশি করেন। গ্রাম্য লোককবিদের রচিত, লোকমুখে প্রচলিত অহিরাগুলির মূলভাষা কুড়মালি। পুরুলিয়ার উত্তরাংশে, পশ্চিম মেদিনীপুর, ছোটনাগপুরের হাজারিবাগ, রাঁচীর পাঁচ পরগণা অঞ্চলে প্রচলিত অহিরাতে কখনো ফুটে ওঠে সরল কথায় মানব জীবনের জীবনদর্শন। অনার্য সভ্যতার প্রতিনিধিদের একান্ত নিজস্ব বাঁদনা পরবের স্মৃতিটুকু বেঁচে থাকে মনের গভীরে। প্রবহমান সময়ে সুবর্ণরেখা, কংসাবতী, দামোদর নদীতে বহু জল গড়িয়েছে। কুড়মি জাতির উপর, কুড়মালী ভাষা, সংস্কৃতির উপর, সারনা ধরমের উপর সময়ে সময়ে বহু ঘাত প্রতিঘাত এসেছে , তথাপি কুড়মি জাতি তার নিজস্ব জাতিসত্ত্বা, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম অক্ষত অবস্থায় বুকে আঁকড়ে রেখেছে।

ভাদুতলায় বাদনা পরব :

শনিবার বিকেলে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গল অধ্যুষিত ছোট্ট গ্রাম ধান্যসোলে কুর্মী সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীরা মেতে উঠেছিল বাঁদনা পরবে। হর্ষধ্বনি দিয়ে সমবেত জনতা গেয়ে উঠেছিল- “এতদিন চরালি ভালা, কোচাখুঁদি রে, আজ তো দেখিব মরদানি/ চার ঠেঙে নাচবি, দুই শিঙে মারবি, রাখিবি বাগাল ভাইয়ের।” অন্যদিকে, দাঁতনের মুকুন্দপুর এলাকার বৈগা সমাজের পরিচালনাতেও বাঁদনা পরবের আয়োজন করা হয়। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও প্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে এদিনের অনুষ্ঠান শুভ সূচনা হয়। শুভ সুচনা করেন বিশিষ্ট সমাজসেবী ও শিক্ষক ভদ্র হেমব্রম ও বিশিষ্ট সাংবাদিক লক্ষণ রায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ নির্মল ঘোষ, আদিবাসী বৈগা সমাজের সভাপতি বসন্ত রাউত, সারাবাংলা বৈগা সমাজের সভাপতি তরনীকান্ত রাউত প্রমুখ।

News Desk

Recent Posts

Vidyasagar University: আবহাওয়ার নিখুঁত খবর জানতে ISRO-র সহযোগিতায় আকাশে যন্ত্র লাগানো বেলুন পাঠাল বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৩ জুন: রবিবার (২২ জুন) দুপুর ঠিক ২টো ১…

1 day ago

Midnapore: “১৯৭৮-এর পর এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেনি গড়বেতা!” আসরে NDRF-SDRF; প্লাবন পরিস্থিতি চন্দ্রকোনাতেও

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২০ জুন: ১৯৭৮ সালের পর এমন ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির…

4 days ago

Midnapore: মিয়াজাকি, ব্ল্যাকস্টোন থেকে আম্রপালি, হিমসাগর; মেদিনীপুরে জমজমাট ‘আম উৎসব’

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৮ জুন: ৩০ টাকা প্রতি কেজি থেকে ৩ লক্ষ…

6 days ago

Kharagpur: খড়্গপুরের কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ! মৃত্যু এক শ্রমিকের

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, খড়্গপুর, ১৭ জুন: গ্লিসারিন কারখানায় ওয়েল্ডিং- এর কাজ চলাকালীন ভয়াবহ বিস্ফোরণ!…

1 week ago

Midnapore: প্রায় দু’দশক পরে পশ্চিম মেদিনীপুরে শুরু হয়েছিল প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া; থমকে গেল আদালতের নির্দেশে

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৬ জুন: ২০০৮ এর পর ২০২৫। দীর্ঘ প্রায় দুই…

1 week ago

Elephant: হাতির পালকে তাক করে ছোঁড়া হচ্ছে একের পর এক জ্বলন্ত হুলা; নেটমাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে পড়তেই নিন্দার ঢল

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, খড়্গপুর, ১৩ জুন: হাতির পালকে তাক করে ছোঁড়া হচ্ছে একের পর…

2 weeks ago