দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৭ জুলাই: “বড়রা আমার প্রণাম নেবেন। ছোটরা নেবেন ভালোবাসা। দীর্ঘ এত বছর ধরে আমার সম্পর্কে আপনারা যা কিছু শুনেছেন বা লিখেছেন, তার সত্য-মিথ্যা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তবে, সেসব এখন অতীত! এখন থেকে আমি নতুন জীবন শুরু করতে চলেছি। আমার বাকি জীবন আমি আমার পরিবার-পরিজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে সুন্দর ভাবে কাটাতে চাই। সেকথা জানানোর জন্যই আজ আমি আপনাদের এখানে ডেকেছি।” শনিবাসরীয় সন্ধ্যায় ঠিক এভাবেই সাংবাদিক বৈঠক শুরু করেছিলেন ‘রেল শহর’ খড়্গপুরের একসময়ের ‘ত্রাস’ কিংবা ‘বেতাজ বাদশা’ বাসব রামবাবু। দুরু দুরু বুকে ‘দস্যু রত্নাকর’ এর ‘বাল্মিকী’ হয়ে ওঠার আন্তরিক বাসনা কিংবা প্রাণপণ প্রচেষ্টার কথাগুলি মন দিয়ে শুনছিলেন খড়্গপুর ও মেদিনীপুরের সাংবাদিকরা। ২৬ মিনিটের সাংবাদিক বৈঠকে এক অচেনা রামবাবু-কেই যেন প্রত্যক্ষ করলেন তাঁরা! রামবাবু বলেন, “আপনারা জানেন, আমাকে কিভাবে ফাঁসানো হয়েছিল! কিভাবে শ্রীনু নাইডু হত্যা-মামলায় ষড়যন্ত্র করে আমার নাম ঢোকানো হয়েছিল। তবে যাই হোক, সাড়ে ৬ বছর পর আমি সুবিচার পেয়েছি (‘হামকো ন্যায় মিলা’)! আমার বয়স এখন ৬১-র বেশি হয়ে গেছে। বাকি জীবনটা সৎ পথে ব্যবসা করে কাটাতে চাই। আমি ঘোষণা করছি, অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত খড়্গপুরের যতগুলি গ্যাং বা গ্রুপ আছে; কারও সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক থাকবেনা। নেইও।”
খড়্গপুর শহরের ১৫ নং ওয়ার্ডের মালঞ্চ রোডে নিজের বাড়িতে দীর্ঘ প্রায় আধ ঘন্টার সাংবাদিক বৈঠকে একাধিকবার শ্রীনু নাইডু মার্ডার কেসে তাঁকে অন্যায়ভাবে ফাঁসানোর কথা বললেও, রামবাবু একবারও এর ‘বদলা’ বা ‘প্রতিহিংসা’র কথা শোনাননি। তিনি জানান, “তৎকালীন পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ আমাকে ফাঁসিয়েছিলেন। অন্যায়ভাবে এই মামলায় আমার নাম ঢুকিয়েছিলেন। দিলীপ ঘোষকেও ফাঁসানো হয়েছিল। তবে, তিনি নেতা বলে বেঁচে গেছেন। আমি তো আর নেতা নই, তাই আমাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়।” কিন্তু, সাংবাদিকরা বারবার প্রশ্ন করলেও, পাল্টা তিনি ভারতী ঘোষের বিরুদ্ধে কোন মামলা বা শ্রীনু নাইডু মার্ডার কেস নিয়ে নতুন করে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেননি। বরং বলেছেন, “আমি নির্দোষ ছিলাম। আমি ন্যায় বিচার পেয়েছি। কে দোষী বা কারা জড়িত তা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।” ভারতী ঘোষের বিরুদ্ধে মামলা করবেন? একসময়ের ‘ডন’ রামবাবু জানান, “এখন আর মামলা করে কি হবে! আর, উনিও তো পুলিশ সুপারের পদ ছেড়ে-টেড়ে দিয়ে অন্য জগতে (রাজনীতিতে) চলে গেছেন। আর, ওসব করতে চাই না!” অতীতের নানা ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ বা হতাশা প্রকাশ করলেও; ‘নতুন’ এই রামবাবুর মধ্যে কোন ‘রাগ’ বা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং রামবাবু বলেন, “এটা ঠিক যে খড়্গপুরের অলিতে-গলিতে এখন দাদা তৈরি হয়ে গেছে। তবে, এসব দূর করতে কখনো যদি পুলিশ আমার কাছে কোন সাহায্য চায়, আমি যথাসাধ্য সহায়তা করব।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নে রামবাবু এও জানিয়ে দেন, তিনি রাজনীতিতে আসবেন না। অতীতেও যে তিনি কখনো সরাসরি রাজনীতিতে ছিলেন না, তাও স্পষ্ট ঘোষণা করে দেন। ২০১৫-র পৌরসভা নির্বাচনে আপনিতো তৃণমূলের ঝান্ডা নিয়ে প্রচার করেছেন? সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে রামবাবু জানিয়ে দেন, “আমি আমার নিজের ওয়ার্ডের (১৫ নং) প্রার্থী অঞ্জনা সাঁকরের হয়ে প্রচার করেছি। তৃণমূলের হয়ে নয়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে প্রচার করেছি। অঞ্জনা এসে বলছিল, ভাইয়া আমার হয়ে প্রচার করতে হবে। এর আগেও অর্থাৎ ২০১০ সালে আমি যখন সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ফিরে এসেছিলাম, তখনও মুরলীর (বান্টা মুরলী) হয়ে প্রচার করেছিলাম। ও তখন বামফ্রন্টের প্রার্থী ছিল। আমার কাছে এসে সাহায্য চেয়েছিল। আমি সেবার ওর হয়ে প্রচার করেছিলাম। জিতেও ছিল। পরে ও অবশ্য কংগ্রেসে যায়। পরে তৃণমূলে।” উল্লেখ্য যে, ২০১৫ সালে রামবাবুর প্রচারের কারণেই তৃণমূল প্রার্থী অঞ্জনার সাঁকরে জয়ী হয়েছিলেন বলে আপামর খড়্গপুরবাসী শোনান। ২০২২- এর পৌর নির্বাচনে সেই অঞ্জনা সাঁকরেই কংগ্রেস প্রার্থী বান্টা মুরলী (তৃণমূল থেকে কংগ্রেসে ফিরে যান)-র কাছে হেরে যান (জেতার পর বান্টা মুরলী অবশ্য ফের তৃণমূলে যোগ দেন)। তবে, রামবাবু তখন জেলে! ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি, নিজের ওয়ার্ডের (১৮ নং ওয়ার্ডের নিউ সেটেলমেন্টে) কার্যালয়ে (তৃণমূল কংগ্রেসের ওয়ার্ড কার্যালয়ে) বসে কার্যত দিনে-দুপুরে (বেলা ৩টা নাগাদ) খুন হয়েছিলেন ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পূজা নাইডু’র স্বামী তথা ‘রেল মাফিয়া’ শ্রীনু নাইডু। সেই মামলাতেই ২৮ ফেব্রুয়ারি ভিন রাজ্য থেকে গ্রেপ্তার হন রামবাবু। প্রায় সাড়ে ৬ বছর জেলে কাটানোর পর গত ২৭ জুন, রামবাবু সহ ১৩ জন অভিযুক্তকে ‘বেকসুর খালাস’ ঘোষণা করে মেদিনীপুর আদালত। অবশ্য ওই দিনই নয়, গত ৬ জুলাই (বৃহস্পতিবার) ‘জেল-মুক্ত’ হয়ে বাড়ি ফেরেন রামবাবু। এরপর, শনিবার (১৫ জুলাই) সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করেন, “এতদিন অবধি রামবাবু সম্পর্কে যা কিছু শুনেছেন বা লিখেছেন, সেসব এখন অতীত। আমি নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা করছি!” জানান, বাকি জীবনটা ‘সৎ পথে’ ব্যবসা করেই কাটাতে চান। তাঁর বয়স হয়েছে, তাঁর ছেলেরা এখন বড় হয়েছে। রামবাবু বলেন, “ওরাই ব্যবসা করবে, আমি ওদের সাহায্য করব।” কিন্ত, কি ব্যবসা? রামবাবু বলেন, “অনেক ব্যবসা আছে। ছাঁট লোহা (স্ক্র্যাপ আয়রন), প্রমোটিং, জমির কারবার- করতে পারি।” কিন্তু, এই সমস্ত ব্যবসা-ই তো এখন খড়্গপুরের অপরাধ জগতের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে গেছে? রামবাবু বলেন, “সে ক্ষেত্রে খড়্গপুরে আমি নাও করতে পারি। অন্য কোথাও করতে পারি।” তবে, ‘সৎ-পথে’ই যে করবেন, তা ফের একবার স্পষ্ট ভাবে জানান রামবাবু। আপাতত, রামবাবুর এই ঘোষণা ঘিরেই আশা-আশঙ্কার দোলাচলে ‘রেল শহর’ খড়্গপুর!